ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের সময় পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতন হলেও এখন পুরো বিপরীত চিত্র।
টাকা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকার পর বাড়ছে শেয়ারের দর, সেই সঙ্গে গতি ফিরতে শুরু করেছে লেনদেনেও।
আগের সপ্তাহে তিন কর্মদিবসেই সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় নতুন সপ্তাহের প্রথম দিন সূচকে আরও যোগ হলো পয়েন্ট।
সূচক খুব একটা লাফ দিয়েছে এমন নয়, তবে দরপতনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেলা শেষে ১৮ পয়েন্ট বেড়ে বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি আরও বাড়িয়েছে।
পুঁজিবাজারে ধসের কারণে জুলাইয়ের শেষে দ্বিতীয়বারের মতো সব শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা গণনা নিয়ে এক যুগের দাবি পূরণ হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দেয়, শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই বাজারমূল্য ধরে হিসাব হবে এই বিনিয়োগসীমা।
এরপরও ৭ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ কর্মদিবসে ১৬৩ পয়েন্টের পতন হয় ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত দরপতন ইস্যুতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দর ৯৫ টাকায় স্থির করলেও খোলাবাজারে চাহিদা বাড়ার কারণে তা ১২০ টাকা হয়ে যায়।
গত সপ্তাহ থেকে ডলার তেজ হারাতে শুরু করে। এখন তা ১১০ টাকার নিচে নেমে ১০০ টাকার দিকে ছুঁটছে। আর গত সপ্তাহ থেকে পুঁজিবাজারও ভালো হতে শুরু করে।
গত সপ্তাহে দুটি সরকারি ছুটির কারণে লেনদেন হয় তিন দিন। এই তিন দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৯২ পয়েন্ট। আর লেনদেন ৫৮৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয় ১ হাজার ১৫৯ কোটি টাকায়।
রোববার সেখান থেকে লেনদেন অবশ্য কিছুটা কম হয়েছে। দিন শেষে হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৬ লাখ ২ হাজার টাকা। বেশির ভাগ শেয়ারের দর অবশ্য কমেছে। ১৪৩টির দরপতনের বিপরীতে বেড়েছে ১৩৬টির দর। ১০২টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে আগের দিনের সমান দামে।
সকালে সূচক বেড়ে লেনদেন শুরু হলেও একপর্যায়ে তা কিছুটা কমে যায়। তবে শেষ বেলায় আবার ক্রয়চাপে বাজার ইতিবাচক হিসেবে শেষ হয়।
আগের সপ্তাহে পর পর তিন কর্মদিবসের পর নতুন সপ্তাহের প্রথম দিনও সূচক বেড়েছে পুঁজিবাজারে
বেশির ভাগ কোম্পানি দর হারালেও সূচক বাড়ার কারণ বহুজাতিক বড় মূলধনি কয়েকটি কোম্পানির পাশাপাশি দেশি বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি। আর ফ্লোর প্রাইসের কারণে দর হারানো কোম্পানিগুলো সূচকে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
লেনদেনের বিষয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেটে পড়েছিল সেখান থেকে উঠছে। এটার একটা কারণ হতে পারে ফ্লোর প্রাইস, যা মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে যে, এর নিচে দর নামতে পারবে না। এ ছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারবান্ধব মনোভাব হয়তো কিছুটা আস্থা ফেরাতে পেরেছে। তা না হলে চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে হয়তো আরও খারাপ হতে পারত বাজার।’
লেনদেনে সেরা বস্ত্র, আগ্রহ বেক্সিমকোতেও
গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বস্ত্র খাতে বিনিয়োগকারীদের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেটি দেখা গেল আবার। দর বাড়ার সঙ্গে লেনদেনও শীর্ষে রয়েছে খাতটি।
আর একক কোম্পানি হিসেবে আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। শেয়ার সংখ্যা ও টাকার অঙ্কে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে কোম্পানির।
বস্ত্র খাতে লেনদেন হয়েছে ১৯৯ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার। দর বেড়েছে ২৩টি কোম্পানির। অন্যদিকে ১৬টি বা ২৭ শতাংশের বেশি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে। আর দর কমে লেনদেন হয়েছে ২০টির, অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ৯০ শতাংশ কোম্পানির।
একক কোম্পানি হিসেবে ৪ হাজার ৬৫৩ বারে বেক্সিমকোর মোট ৭৯ লাখ ৮১ হাজার ২৮৭টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ ৯৫ কোটি ৯১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। শেয়ারটির সর্বশেষ দর ছিল ১২০ টাকা ২০ পয়সা, যা আগের দিনের চেয়ে ৫০ পয়সা কম।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বিবিধ খাতে। ১৮২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা লেনদেনের দিনে খাতটিতে দরবৃদ্ধির চেয়ে দরপতনই বেশি হয়েছে। ৭টি বা ৫০ শতাংশ কোম্পানির দর পতনের বিপরীতে বেড়েছে ৫টি বা ৩৫ শতাংশ কোম্পানির। আর দুটি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে আগের দরেই।
এ ছাড়া প্রকৌশল খাতে ১০৭ কোটি ৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ১৮টির বৃদ্ধি ও ৯টি কোম্পানির শেয়ার অপরিবর্তিত দরে লেনদেন হওয়ায় দর পতনের হার কমেছে। দর কমে লেনদেন হয়েছে ১৫টি বা ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কোম্পানির।
আর কোনো খাতের লেনদেন একশ কোটি স্পর্শ করতে পারেনি। তবে লেনদেনে ওপরের দিকে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন, খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক, তথ্যপ্রযুক্তি, সিমেন্ট ইত্যাদি।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ৩ দশমিক ৯৮ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ। শেয়ারটির দর ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দর শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ২৮ পয়েন্ট।
বিকন ফার্মা সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ৯৮ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এ ছাড়া তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, রহিমা ফুড, ওরিয়ন ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা ও কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৪৬ পয়েন্ট।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট সূচক কমেছে ইউনাইটেড পাওয়ারের দর পতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ।
আর কোনো কোম্পানি সূচক ১ পয়েন্ট কমাতে পারেনি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৭৬ পয়েন্ট কমেছে বেক্সিমকো ফার্মার কারণে। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
আইসিবির দর শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৭৫ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেক্সিমকো, সোনালী পেপার, স্কয়ার টেক্সটাইল, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল ও ডেসকোর দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৬ দশমিক ২ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দর বেড়েছে মুন্নু ফেব্রিকসের। তিন কর্মদিবস বাড়ল শেয়ারটির দর। আগের কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছিল ২৫ টাকায়। রোববার সর্বশেষ হাতবদল হয়েছে ২৭ টাকা ৫০ পয়সায়।
মেট্রো স্পিনিং দর বৃদ্ধির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এক দিন কমার পরে আবারও দর বাড়ল শেয়ারটির। ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ টাকা ৩০ পয়সায়।
ঋণ কেলেঙ্কারি ও লোকসানে ডুবে থাকা ইউনিয়ন ক্যাপিটালের দর বেড়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
৯ দশমিক ২ শতাংশ দর বেড়ে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১১ টাকা ৫০ পয়সায়।
এ ছাড়া দর বৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে রহিমা ফুড, ওরিয়ন ফার্মা, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ, বিডি ল্যাম্পস, অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি (প্রাণ) ও ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ঝিল লোকসানি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি। শেয়ারটির দর ৬ টাকা ৭২ শতাংশ কমে ১১ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়।
বিডি থাই ফুড দর পতনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল। শেয়ারটির দর ১ টাকা ৬০ পয়সা বা ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ কমেছে। শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা ৬০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ১ টাকা ৮০ পয়সা বা ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৫৫ টাকা ২০ পয়সায় হাতবদল হয়।
শীর্ষ দশে বাকি কোম্পানিগুলো ছিল সোনারগাঁও টেক্সটাইল, হা-ওয়েল টেক্সটাইল, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম টেক্সটাইল, আমান ফিড ও ফার কেমিক্যাল।