বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে সংস্কার চাইছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের ফর্মুলা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম বাড়বে, তখন দেশের ভেতরে সরকার দাম বাড়াবে। আবার দাম কমলে সেই অনুপাতে দাম কমাতে হবে।
আইএমএফ বলছে, এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দাম সমন্বয় করা হলে তেলের দাম স্থিতিশীল হবে, একই সঙ্গে এ খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি লাগে, তা কমে আসবে।
আইএমএফের একটি মিশন সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বিভিন্ন সুপারিশের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে আলাদা ফর্মুলা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। একই সঙ্গে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে বলেছে তারা। এ সময় বিভিন্ন খাতে বেশ কয়েকটি সংস্কারের কথাও বলেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক ঋণদানকারী এই সংস্থাটি।
বর্তমানে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ফিক্সড প্রাইস বা নির্দিষ্ট দামের ভিত্তিতে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে এটা করা হয়। যদিও আইনে গণশুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটারি কমিশনের দাম নির্ধারণের কথা। কিন্তু বাংলাদেশে তা কখনই মানা হয়নি।
চলমান সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে আইএমএফের কাছে। ঋণের শর্ত কী হবে, তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলবে তারা। এরই মধ্যে সারের দাম কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার।
আইএমএফের পাশাপাশি দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরাও ‘বাজার মূল্যে’ জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বিশ্ববাজারে যখন উচ্চমূল্য থাকে, তখন দেশের বাজারে বাড়ানো হয়। কিন্তু দাম কমলে আর কমানো হয় না। ফলে জনমনে অস্থিরতা তৈরি হয়। পাশের দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই ‘বাজার মূল্যে’ দাম নির্ধারণ করা হয় বলে জানান তারা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০ বছরে দেশে ১৮ বার জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হয়। সর্বশেষ শুক্রবার ডিজেল ৮০ টাকা থেকে দাম বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা এবং কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করে তা কার্যকর করা হয়। দেশে এর আগে কখনই একবারে এত দাম বাড়ানো হয়নি।
বাংলাদেশে এখন বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ টন। এর ৭০ শতাংশই ডিজেল এবং এর পুরোটাই আমদানি করতে হয়। বাকি অংশ অকটেন ও পেট্রল। পেট্রল দেশে তৈরি হলেও অকটেন চাহিদার ৫০ শতাংশ আমদানি করা হয়।
তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বের দেশগুলো প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এর মধ্যে অধিকাংশই বাজারদরের সঙ্গে মিল রেখে সমন্বয় করে। কিছু দেশ আছে প্রাইস সিলিং বা সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। আর সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি হলো ফিক্সড প্রাইস বা এক দর পদ্ধতি। ফিক্সড প্রাইস সরকার নির্ধারিত থাকে। তবে এটি সর্বোচ্চ মূল্যের ওপরে উঠতে পারে না। সেই সময়ে সরকার ভর্তুকি দেয়। বাংলাদেশে সরকার দাম নির্ধারণ করে এবং ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয়।
প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় এবং বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে সেখানে।
এ পদ্ধতিতে প্রতি দিনই বাজারদর অনুযায়ী দাম সমন্বয়ের সুযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানেও বাজারমূল্যের সঙ্গে তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হয়।
সরকার যে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতি অনুসরণ করে, তার ফলে বিশ্ববাজারে আচমকা দাম বেড়ে গেলেও ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। ফলে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যায়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সরকার দেশের মধ্যে দাম বাড়ায়। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে, তখন আর দেশের বাজারে কমায় না। ফলে তেলের মূল্য কম থাকার যে সুবিধা, সেটি থেকে ভোক্তারা বঞ্চিত হন। যে কারণে বাংলাদেশে তেলের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে সংস্কার চাইছে আইএমএফ।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা ফর্মুলা করে দেয়া হোক। আইএমএফও একই কথা বলে আসছে। আমরা এ প্রস্তাব বহু আগে থেকে দিয়ে আসছি সরকারকে। কিন্তু তা আমলে নেয়া হচ্ছে না।
‘এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে জনগণ বুঝত, দাম বৃদ্ধি করা উচিত হবে কি হবে না। কত দাম নির্ধারণ করা উচিত।’ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম সমন্বয় করা হলে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর একই অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘সরকার এখন নিজেই তেলের দাম ঠিক করে দেয়। এখান থেকে বের হতে হবে। সরকারের উচিত হবে দাম নির্ধারণের পদ্ধতি থেকে বের হয়ে বাজারমূল্যের ভিত্তিতে তা ঠিক করা। প্রয়োজনে ব্যক্তি খাতকে তেল আমদানির অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তা হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে।’
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের একটি ফর্মুলা ঘোষণা করা দরকার। মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি সংস্কার করা হলে ভর্তুকি কমে যাবে।’
বিগত কয়েক বছর ধরে জ্বালানি তেলে সরকার কোনো ভর্তুকি দিচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয় ৬০০ কোটি টাকা।
তবে ২০২১ সালে করোনা-পরবর্তী জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে অনেক বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে এ মূল্য প্রতি ব্যারেলে ১১৩ মার্কিন ডলারে ওঠে, যদিও এটি কমে বর্তমান ৯৮ ডলারে এসেছে। অস্বাভাবিক এ মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার এক দফা জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে।
এরপরও ওই বছর প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি লেগেছে জ্বালানি তেলে। এখন আবার দাম বাড়িয়েছে সরকার। দাম বাড়ার পরও ভর্তুকি এবার ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।