উচ্চ মুনাফা ও বিনিয়োগে নিরাপত্তার সুবাদে গ্রাহকের আস্থার শীর্ষে ছিল সঞ্চয়পত্র। ফলে দিনে দিনে বাড়তে থাকে বিক্রি। আর বছর শেষে সুদ বাবদ ভর্তুকির চাপে পড়ে সরকার। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। জনপ্রিয় সঞ্চয়পত্রে কমছে গ্রাহকের আগ্রহ। কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কড়াকড়ি।
সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে এনবিআর। আর্থিক সংকট প্রকট হওয়ায়, সুদ বাবদ ব্যয়ে লাগাম টানতে নেয়া হয়েছে এই নিয়ন্ত্রণ কৌশল।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রির পরিমাণ ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ৭৫ লাখ টাকা। এটা লক্ষ্যের চেয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম। অথচ আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে সুদের দায় মিটিয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
বাড়ছে সুদ ব্যয়
২০২১-২২ অর্থবছরে এক লাখ আট হাজার ৭০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ অর্থের বিপরীতে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে নিট বিক্রি ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এটা বাজেট ঘাটতি মেটাতে এ খাতের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৬২ দশমিক ২৩ শতাংশ। ওই অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) বিক্রি হয় এক লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭০ হাজার ২২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসাবে ওই অর্থবছরের নিট বিক্রি ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এটা আগের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রায় তিন গুণ বেশি। ওই অর্থবছরে নিট বিক্রি হয় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে সরকার।
সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়ে দেয় সরকার।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে এক রকম, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে এক রকম ও ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেক রকম সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হারে সরকার হাত দেয়নি। অর্থাৎ আগে যে হারে সুদ পাওয়া যেত, এখনও সেই হারে পাওয়া যাচ্ছে।
শর্তের বেড়াজালে বিনিয়োগকারীরা
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার।
সবশেষ পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এসব কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন।
করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও কর শনাক্তকরণ নম্বর দিতে হচ্ছে। এটা বাড়তি ঝামেলা বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারী রফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেয়াটা খুবই জটিল কাজ।
সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে টিআইএন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারী আবুল হোসেন। তিনি মন্তব্য করেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি খুবই বিরক্তিকর কাজ। অনলাইনে কেনা ও মুনাফা তোলার কাজটি এগোচ্ছে কচ্ছপ গতিতে।
মুনাফা তুলতে আসা বিনিয়োগকারী আমেনা খাতুন বলেন, ‘ব্যাংকের তুলনায় সুদ হার ভালো বলে এখানে আমরা বিনিয়োগ করতে চাই। কিন্তু কর নম্বর দেয়া কঠিন কাজ। আমরা সাধারণ মানুষ এই কঠিন মারপ্যাঁচ বুঝি না।’
ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুবিধা বেশি
ব্যাংক খাতে জুন শেষে আমানতের বিপরীতে গড় সুদ হার ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ৷ একই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ৷ অথচ পাঁচ বছর আগেও সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সুদ হার যতটুকু, তার সবটাই আবার হাতে আসে না। বাদ দিতে হয় ব্যাংকের চার্জ ও সরকারের শুল্ক। এর মানে টাকার মূল্যমানের অবচয় বিবেচনায় আমানতকারী যে পরিমাণ টাকা রাখছেন, বছর শেষে পাচ্ছেন তার চেয়ে কম।
এ কারণে ব্যাংকে টাকা রেখে সঞ্চয়কারীরা এখন আর প্রকৃত অর্থে লাভবান হতে পারছেন না৷
ব্যাংকের সুদহারের সঙ্গে বড় ধরনের তফাতে গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের টাকা জমা রাখার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সঞ্চয়পত্র৷
তবে এখানে বিনিয়োগে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে কেউ সঞ্চয়পত্র কেনার পর এক বছরের মধ্যে ভাঙালে কোনো সুদ পান না। তবে সুদ হার বেশি হওয়ায় গত কয়েকটি অর্থবছরে এর বিক্রি সরকারের বাজেটে ধরা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে৷
সঞ্চয়পত্রে সুদ হার না কমিয়ে বিক্রি কমাতে ২০১৯ সালের মে মাস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনায় বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা শুরু করে সরকার। টিআইএনের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র কেনা ও মুনাফা নেয়ার জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা কমানো এবং ঘোষণার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে সব অফিস থেকে অভিন্ন সফটওয়্যারে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে সম্প্রতি জারি করা জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর ও সরকারি গেজেট অনুযায়ী, এখন থেকে যদি কোনো ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ অথবা পোস্টাল সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট খুলতে চায়, তবে সবশেষ বছরের আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এসব কঠিন শর্ত আরোপের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন স্কিম
বর্তমানে দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র স্কিম প্রচলিত আছে। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
২০১৫ সালের ২৩ মে থেকে এ হার কার্যকর রয়েছে। তার আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশের বেশি।
তবে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগে মুনাফার হার ২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে।