সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়ার পর টানা দুই দিন সূচকের পাশাপাশি বাড়ল লেনদেন। এর মধ্যে প্রথম কর্মদিবসের তুলনায় দ্বিতীয় দিন সূচক বৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও লেনদেনে দিয়েছে লাফ।
২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণের পর ফ্লোর প্রাইসে বিপুলসংখ্যক কোম্পানির শেয়ার একেবারেই লেনদেন না হলেও এবারের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। যেদিন ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়, সেদিনের তুলনায় লেনদেন হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
ফ্লোর প্রাইসে প্রথম দিন রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ১৫৩ পয়েন্ট, লেনদেন হয় ৫৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
- আরও পড়ুন: ফ্লোর প্রাইসে বছরের দ্বিতীয় সেরা উত্থান
সোমবার সেখান থেকে সূচক আরও বাড়ে ৩০ পয়েন্ট। তবে লেনদেন এক লাফে ছাড়ায় ৯০০ কোটি টাকার ঘর। সব মিলিয়ে হাতবদল হয় ৯২১ কোটি ৭৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকার শেয়ার, যা আগের দিনের চেয়ে ৩৫৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি।
গত বৃহস্পতিবার যেদিন ফ্লোর প্রাইস দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন লেনদেন ছিল ৪৪১ কোটি ৭৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
সোমবারের এই লেনদেন গত ১৭ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ৫ জুলাই এর চেয়ে বেশি ৯৬০ কোটি ৭৯ লাখ ৬১ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছিল।
অর্থাৎ প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারদর একটি সীমার নিচে নামতে পারবে না- এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হতে শুরু করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার কেনা শুরু করছেন।
অবশ্য কেবল ফ্লোর প্রাইস নয়, বিনিয়োগকারীদের জন্য উৎফুল্ল হওয়ার মতো আরও একটি সংবাদ দিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম।
বহু বছর ধরেই পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণে সুপারিশ করে আসছিল বিএসইসি। এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি উপেক্ষা করলেও আবদুর রউফ তালুকদার গভর্নর হওয়ার পর নীতি পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এক্সপোজার লিমিট বাজারমূল্যে থাকলে কোনো কোম্পানির শেয়ারদর বেড়ে গেলে ব্যাংক সেটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে বাজারে বিক্রয়ের চাপ আসে। সেটি না হয়ে ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার লিমিট নির্ধারণ হলে এই সমস্যা থাকবে না।
সম্প্রতি গণনা পদ্ধতি পাল্টানোর বিষয়ে সরকারের মত জানতে চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পাশাপাশি বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ তার এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম রোববার একটি আয়োজনে জানিয়েছেন, এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যেই হবে এবং শিগগির সিদ্ধান্ত আসছে।
এসব ঘটনায় হতাশার পুঁজিবাজারে নতুন করে আশা তৈরির দ্বিতীয় দিন বেড়েছে ২০৩টি কোম্পানির শেয়ারদর। বিপরীতে কমেছে ১০২টির দর। ৭৭টির দর ছিল অপরিবর্তিত।
ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের দ্বিতীয় দিন সূচক বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে
বস্ত্র, প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং বিবিধ খাতের বেশির ভাগ কোম্পানির দর বেড়েছে।
বস্ত্র খাতে ১২টির দরপতন ও ৮টির দর অপরিবর্তিত থাকার বিপরীতে বেড়েছে ৩৯টির দর; প্রকৌশল খাতে ৫টির দরপতন ও ৮টির দর অপরিবর্তিত থাকার বিপরীতে বেড়েছে ২৯টির দর।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে ৫টির দরপতন, ৪টির দর অপরিবর্তিত থাকার দিন বেড়েছে ২২টির দর; খাদ্য খাতে ৩টির দরপতন, চারটির দর অপরিবর্তিত থাকার বিপরীতে বেড়েছে ১৪টির দর।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৬টির দরপতন, ৪টির দর অপরিবর্তিত থাকার দিন বেড়েছে ১৩টির দর আর বিবিধ থাকে ৩টির দরপতন, দুটির দর অপরিবর্তিত থাকার দিন বেড়েছে ৯টির দর।
সোমবারের লেনদেন নিয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন নিউজবাংলাকে বলেন, 'এখন ট্রানজেকশন কমবে না বরং বাড়বে। ফ্লোর প্রাইস কার্যকর করার কারণে একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। সবাই জানেন যে নির্ধারিত দামের নিচে শেয়ারদর নামবে না। ফলে এই টাকায় শেয়ার কিনলে এর নিচে নামার আশঙ্কা নাই বরং যতটুকু বাড়বে ততটুকুই লাভ।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারী যারা শেয়ারের দর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামার পরে কেনার অপেক্ষায় ছিলেন, তারাও দেখছেন যে এর চেয়ে বেশি দর কমার সুযোগ নেই। এখন তারা যদি না কেনে, তাহলে অন্য বায়ার দাঁড়িয়ে যাবে। ফলে তারা শেয়ার কেনার সুযোগটা হাতছাড়া করছেন না। এ জন্য ট্রানজেকশন বেড়েছে।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দর বৃদ্ধি পাওয়া শীর্ষ ১০টি কোম্পানির মধ্যে চারটির দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। একটির ৮, দুটির ৭, দুটির ৬ এবং একটির ৫ শতাংশের বেশি দর বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এস্কয়ার নিট কম্পোজিটের। ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর বেড়ে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৩৯ টাকা ৭০ পয়সা। এ নিয়ে টানা তিন কর্মদিবস দর বাড়ল শেয়ারটির।
২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর থেকে প্রতিবছরই ১৫ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পেয়েছে হা-ওয়েল টেক্সটাইলের। কোম্পানির শেয়ারদর বছরজুড়ে ওঠানামা করতে দেখা যায়।
দুই কর্মদিবস পতনের পরে টানা তিন কর্মদিবস দর বাড়ল শেয়ারটির। প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৫৪ টাকা ৪০ পয়সায়।
২০১৪ সালে তালিকাভুক্তির পর থেকেই কোম্পানি ১৫ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়া শুরু করে। এরপর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ করে এবং ২০২০ ও ২০২১ সালে ২০ শতাংশ বা ২ টাকা লভ্যাংশ পেয়েছিলেন এর বিনিয়োগকারীরা।
৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ দর বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৭ সালের পরে লোকসানি কোম্পানিটির কোনো অপারেশনাল তথ্য নেই। ওই বছর শেয়ার প্রতি ৬৯ টাকা ৫৫ পয়সা লোকসান দিয়েছিল কোম্পানি।
তার পর মাঝে মাঝে দর বাড়তে দেখা যায় কোম্পানির শেয়ারের। পর পর দুই দিন দর বেড়ে শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৪০ পয়সায়।
এ ছাড়াও শীর্ষে দশে জায়গা করে নিয়েছে তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যামবি ফার্মা, শেফার্ড ইন্ডাস্টিজ, জেএমআই হসপিটাল, মালেক স্পিনিং, সাভার রিফ্যাক্টরিজ এবং ইবিএল এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
দর পতনে ইন্স্যুরেন্সের আধিপত্য
দর পতনের শীর্ষ ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৯টিই বিমা খাতের। এর মধ্যে একটির ৪ ও ৯টির দর কমেছে ৩ শতাংশের বেশি।
সবচেয়ে বেশি দর কমেছে তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের। আগের কর্মদিবসে উত্থানের পরে আজ ৪ দশমিক ০৬ শতাংশ দর কমে ৪৯ টাকা ৬০ পয়সা।
এরপরেই দর কমেছে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের। ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ দর বেড়েছে শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা ৯০ পয়সায়।
তৃতীয় স্থানে থাকা এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৪২ টাকা ৬০ পয়সা, সেটি আজ দাঁড়িয়েছে ২৯ টাকা ৩০ পয়সায়।
এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে পাইনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, জনতা ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা ইন্স্যুরেন্স ও এসইএমএল আইবিবিএল শরিয়াহ ফান্ড।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ৮ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির দর ১ দশমিক ১৯ শতাংশ দর বেড়েছে।
আইসিবির দর ২ দশমিক ০২ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো সূচকে যোগ করেছে ২ দশমিক ০৪ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এ ছাড়া ইউনাইটেড পাওয়ার, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, বিকন ফার্মা, ওয়ালটন হাইটেক, ওরিয়ন ফার্মা, জেএমআই হসপিটাল এবং সাইফ পাওয়ার সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট সূচক কমেছে ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকোর কারণে। এ দিন কোম্পানিটির দর কমেছে শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৮৭ পয়েন্ট কমিয়েছে স্কয়ার ফার্মা। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ।
হাইডেলবার্গ সিমেন্টের দর ৩ দশমিক ০৭ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্ট।
এ ছাড়া বাটা সু, গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, এনআরবিসি ব্যাংক, বিএসআরএম, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ব্যাংকের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৫ দশমিক ৯৪ পয়েন্ট।