বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এক মাসে রিজার্ভ থেকে ১.১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি

  •    
  • ৩১ জুলাই, ২০২২ ২০:৩০

বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, ডলারের বাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।

বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববারও ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৪ কোটি (১.১৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা) তুলে নেয়া হয়েছে।

এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। গত সপ্তাহের শেষ দিকে রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

ডলার বিক্রির পরও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ায় সেই রিজার্ভ খানিকটা বেড়ে রোববার ৩৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।

বাজারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির চাপেই মূলত রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠছে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের আগস্টে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার বড় অবদান ছিল।

গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। পরে তা আরও কমে ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

এক বছর আগে ২৭ জুলাই রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, ডলারের বাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।

কয়েক মাস ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা ঠিক করে দিয়েছে, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।

প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার টাকার অবমূল্যায়নও হচ্ছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তব্যাংক লেনেদেনের ক্ষেত্রে যে দর ঠিক করেছে, ব্যাংক ও খোলাবাজারে তার থেকে অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে খোলাবাজারে ডলারের দাম রেকর্ড ১১২ টাকায় উঠেছিল। রোববার অবশ্য খানিকটা কমে ১০৮ টাকায় নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলো ১০৫ থেকে ১০৮ টাকা দর রাখছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ৯ থেকে ১৪ টাকা বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামকে আন্তব্যাংক দর বলা হয়ে থাকে। এই দর আসলে এখন অচল। বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দরে ডলার কেনাবেচা করতে ব্যাংকগুলোকে কোনো চাপ দিচ্ছে না।

ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো দামে তাদের নিজের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করছে; নগদ ডলারও বিক্রি করছে অনেক বেশি দামে।

এ হিসাবে এক বছরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর ব্যাংক ও খেলাবাজারে বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।

ডলারের অস্থির বাজার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন।

গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে অচল। এটাকে সচল করতে হবে। চলমান ডলার বাজারের অস্থিরতায় হয়তো কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আস্থা বাড়াতে হবে। আমাদের মতো দেশে ডলারের বাজার একেবারে ফ্রি ফ্লোর করা সম্ভব না। কিছুটা ম্যানেজ করতে হবে।’

মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।

অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।

আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।

সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই একই জায়গায় ‘স্থির’ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকেই রিজার্ভ নিয়ে সারা দেশে আতঙ্ক ও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। মে মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

এ হিসাবেই বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

রিজার্ভ কমার কারণ জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই ব্যয় বাড়ার অবশ্য কারণ ছিল, জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে দুই গুণ-তিন গুণের মতো।’

‘তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, গত বছরের আগস্টে আমাদের রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল, তাতে কিন্তু দর ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো কিনেছিল তার একটা অবদান ছিল।’

‘আর এখন গত অর্থবছর এবং নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে সবমিলিয়ে যে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার মতো বিক্রি করেছে, সে কারণেই কিন্তু রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।’

‘আমি মনে করি, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বর্তমানের রিজার্ভ সন্তোষজনক: কোনো ঝুঁকি নেই। তবে এর চেয়ে যেনো বেশি না কমে তার জন্য একদিকে যেমন আমদানির লাগাম টেনে ধরতে হবে; অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে জোর দিতে হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।

তবে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ২৮ দিনেই প্রায় ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

আর আমদানির ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।

এ বিভাগের আরো খবর