ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর পুঁজিবাজারে বড় উত্থান হলো। করোনার সময় ফ্লোর প্রাইসে বিপুলসংখ্যক শেয়ার লেনদেন না হলেও এবার সেটিও দেখা গেছে কম। আগের দিনের চেয়ে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্সের ১৫৩ পয়েন্ট উত্থান সূচককে ছয় হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে ৬ হাজার ১৩৩ পয়েন্টে নিয়ে গেছে। আগের কর্মদিবস বৃহস্পতিবার সেটি গত ১৩ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামার পর তৈরি হয় আতঙ্ক।
সেদিনই ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ২০২০ সালে দেশে করোনা সংক্রমণের পর ধসের মধ্যে ১৯ মার্চও ফ্লোর প্রাইস দেয়ার ঘোষণা আসে। এতে বাজারের ধস থামে।
রোববার ফ্লোরের প্রথম দিন তিন শতাধিক কোম্পানির শেয়ারদর আগের দিনের তুলনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়। এর প্রভাবে লেনদেন শুরুই হয় ৬ হাজার ১৬ পয়েন্ট দিয়ে যা আগের দিনের তুলনায় ছিল ৩৬ পয়েন্ট বেশি।
লেনদেনের অর্ধেক সময় সেখান থেকে সূচক আরও ৪০ পয়েন্টের মতো বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সূচক সব মিলিয়ে যখন ৭০ পয়েন্ট বেশি, সে সময় থেকে শুরু হয় ঊর্ধ্বমুখী টান। লেনদেন শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত সূচক ১৬৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়। তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে সেখান থেকে ১০ পয়েন্ট কমে শেষ হয় লেনদেন।
চলতি বছর এক দিনে সূচক সবচেয়ে বেশি ১৫৫ পয়েন্ট বেড়েছিল গত ৯ মার্চ। ১০০ পয়েন্ট যোগ হয়েছে আরও দুই দিন। এর মধ্যে ২৯ মে ১৩১ পয়েন্ট ও ২৩ মে ১১৮ পয়েন্ট সূচকে যোগ হতে দেখা যায়। এ ছাড়া ১৩ মার্চ বাড়ে ৯৭ পয়েন্ট।
বেলা শেষে বেড়েছে ৩৬২টি কোম্পানির দর। বিপরীতে কমেছে ৭টির আর ১১টি আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে। হাতবদল হয়েছে মোট ৫৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকার শেয়ার। আগের কর্মদিবসে লেনদেন ছিল ৪৪১ কোটি ৭৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের দিন লেনদেন বেড়েছে ১২৬ কোটি ১৮ লাখ ১২ হাজার, যা শতকরা হিসাবে ২৮.৫৬ শতাংশ।
ইতিহাসে দ্বিতীবারের মতো ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের পর প্রথম কর্মদিবসের লেনদেন
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দর সংশোধনে যাওয়ার পর পুঁজিবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এর মধ্যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর থেকে শুরু হয় নতুন এক সংকট।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাস, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে পড়তেই থাকে পুঁজিবাজার।
১৩ মাস পর মূল্যসূচক প্রথমবারের মতো নেমে যায় ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে। এর মধ্যে গত সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসসহ টানা ৯ কর্মদিবসে সূচক পড়ে ৩১৪ পয়েন্ট।
এরপর দুই দিনে ৫৯ পয়েন্ট সূচকে যোগ হলেও পরের দিনেই তার চেয়ে ১৫ পয়েন্ট বেশি পড়ে যায়। শেষ কর্মদিবসে বৃহস্পতিবারেও ৫৭ পয়েন্ট কমে সূচক ৬ হাজারের মনস্তাত্ত্বিক স্তরের নিচে অবস্থান করে।
রোববারের লেনদেনের বিষয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, “পলিসি সাপোর্টের কারণেই (ফ্লোর প্রাইস কার্যকর) মূলত আজকের উত্থানটা হয়েছে। তবে দুপুর একটার পর থেকে ‘নো বাই’ অবস্থান থেকে সরে আসতে দেখা যায়। প্রথমে মিউচ্যুয়াল ফান্ড এবং পরে সব ইনস্ট্রুমেন্টেই বাই প্রেসারটা এসেছে।”
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে সূচকটা বেশি বেড়েছে। তবে শেয়ারদর কমলে কেনার অপেক্ষায় যারা ছিল, তারাও দেখছে যে এর চেয়ে বেশি দাম কমবে না। তাই কিনতে শুরু করেছে।’
ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের সিইও সুমন দাস বলেন, ‘মার্কেটকে এভাবে ব্যারিয়ার দিয়ে ঠেকানো আমরা চাইনি। আজকে তো অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে সূচক বেড়েছে বেশি পরিমাণে। আগামীকাল থেকে হয়ত আসল অবস্থাটা বোঝা যাবে।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষে বিমা খাত
দর বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষ দশের আটটিই বিমা খাতের কোম্পানি। এর মধ্যে প্রথম সাতটির দর বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি। লভ্যাংশজনিত রেকর্ড ডেটের কারণে দর বৃদ্ধি বা কমার ক্ষেত্রে কোনো সীমা না থাকায় কোম্পানিগুলোর ওই পরিমাণ দর বেড়েছে। এ ছাড়াও তিনটির দর বেড়েছে সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ করে।
সবচেয়ে বেশি ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ দর বেড়েছে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের। এর পরেই ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ দর বেড়ে লেনদেন হয়েছে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের।
১১ শতাংশের বেশি বেড়েছে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, ওরিয়ন ইনফিউশন ও ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের দরও।
১০ শতাংশ হারে বেড়েছে তাকাফুল ইন্স্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স ও অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের দর।
দর হারানো ৭ কোম্পানি
লোকসানি দুলামিয়া কটনের দর ১ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৭১ টাকা ৩০ পয়সায়।
এরপরেই দর কমেছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স মিউচ্যুয়াল ফান্ডের। ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমেছে দর।
এরপরেই কমেছে ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্সের দর। ৮০ পয়সা বা ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে সর্বশেষ ৫০ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
ভ্যানগার্ডএএমএল রূপালী ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড লুজার তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে। শেয়ারটির দর ১ দশমিক ৩২ শতাংশ কমে সর্বশেষ ৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
পতনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে যথাক্রমে এইচ আর টেক্সটাইল, ফরচুন সুজ এবং সিটি ব্যাংক।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ১৬ দশমিক ১৬ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির দর ৩ দশমিক ০১ শতাংশ দর বেড়েছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দর ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৯ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।
রবি সূচকে যোগ করেছে ৭ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
ওয়ালটন হাইটেক, আইসিবি, ইউনাইটেড পাওয়ার, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো এবং অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৬১ দশমিক ২৯ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি শূন্য দশমিক ১৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে সিটি ব্যাংকের কারণে। এ দিন কোম্পানিটির দর কমেছে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমিয়েছে ফরচুন সুজ। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এইচ আর টেক্সটাইলের দর ১ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, রূপালী ভ্যানগার্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পিএফ মিউচ্যুয়াল ফান্ড এবং দুলামিয়া কটনের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই সাত কোম্পানি সূচক কমিয়েছে শূন্য দশমিক ৪৬ পয়েন্ট।