ব্যাংকিং খাতে পাহাড়সম খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঋণখেলাপিদের আবারও বড় ছাড় দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এখন থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলি বা নিয়মিত করতে পারবে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের ধরন বিবেচনা করে ব্যাংকের পর্ষদ ঠিক করবে কী ধরনের সুবিধা দেয়া যেতে পারে। তবে ঋণ নিয়মিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে।
‘ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠন’ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে; আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে শোধ করা যাবে। আগে ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে।
তবে নতুন নীতিমালার মাধ্যমে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ এই সুবিধার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি এবং নীতি বিভাগ সোমবার এ-সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক যাচাই-বাছাই করে স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। নতুনভাবে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণীকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হলো।
এতে আরও বলা হয়েছে, এই নীতিমালা ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলি ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যা তাদের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
ব্যাংকের নীতিমালায় প্রজ্ঞাপনে দেয়া শর্তের চেয়ে নমনীয় কোনো শর্ত যুক্ত করা যাবে না।
নীতিমালায় অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অথবা উৎপাদনশীল খাতের অলাভজনক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ থাকতে হবে।
কোনো ঋণগ্রহীতা প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের আবেদন করলে ব্যাংক আবশ্যিকভাবে আবেদনপত্র গ্রহণের তিন মাস সময়ের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের দায় বিবেচনায় নিয়ে গ্রাহকের সামগ্রিক ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা যাচাই করতে হবে।
শ্রেণীকৃত ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলীকরণ করা যাবে। তবে খেলাপি ঋণ আদায়ের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় চতিুর্থ বার পুনঃতফসিল করা যাবে।
ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে মেয়াদি ঋণে ১০০ কোটি টাকার কম হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে ছয় বছর। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হার হবে সাড়ে ৪ থেকে ৭ শতাংশ। ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে সাত বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে সাড়ে ৩ থেকে ৬ শতাংশ। ৫০০ কোটি টাকার ওপর হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে আট বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে আড়াই থেকে ৫ শতাংশ।
তবে তলবি ঋণে ৫০ কোটি টাকার কম হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে পাঁচ বছর এবং ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হার হবে ৪ শতাংশ, ৫০ থেকে ৩০০ কোটির কম হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা ছয় বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে ৩ শতাংশ। ৩০০ কোটি টাকার ওপরে হলে সময়সীমা হবে সর্বোচ্চ সাত বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে আড়াই শতাংশ।
এ ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহকের ঋণ হিসাব দ্বিতীয় পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ সাত বছর হলে তৃতীয় পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ছয় বছর এবং চতুর্থ পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে পাঁচ বছর।
এ ছাড়া কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ প্রথম বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ তিন বছর এবং দ্বিতীয় ও তৎপরবর্তী প্রতিবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ২ বছর ৬ মাস।
ঋণের পরিমাণ বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রেস পিরিয়ড ছয় মাস হবে। তবে গ্রাহকের ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় উক্ত গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ সর্বোচ্চ এক বছর নির্ধারণ করা যাবে।
নীতিমালার আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের পর পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ন্যূনতম ৩ শতাংশ (রপ্তানিকারক ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ) নগদে আদায় সাপেক্ষে ঋণগ্রহীতাকে নতুন ঋণ সুবিধা প্রদান করা যাবে এবং ঋণগ্রহীতার বিদ্যমান ঋণসীমা বৃদ্ধি করা যাবে।
তবে নতুন ঋণ মঞ্জুরি বা ঋণসীমা বৃদ্ধির আগে গ্রাহক প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মর্মে ব্যাংক কর্তৃক নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের পুরোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের নতুন ঋণ প্রদানে ব্যাংক কর্তৃক সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নিয়মিত মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সার্কুলারে বলা হয়েছে, নিয়মিত (অশ্রেণীকৃত: স্ট্যান্ডার্ড বা এসএমএ) মেয়াদি ঋণের বিদ্যমান অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করে ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। কোনো ঋণ হিসাবকে ঋণের মেয়াদের মধ্যে শুধুমাত্র একবার এরূপ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ না করে মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে।
ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ/নির্বাহী কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। পুনঃতফসিলকৃত কোনো ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে না।
নীতিমালার শর্ত অনুযায়ী, তলবি ঋণ, চলমান ঋণ বা মেয়াদি ঋণ বিভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় এ-জাতীয় ঋণসমূহকে একত্রিত করে একক ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিল করা যাবে না। তবে একই প্রকৃতির একাধিক ঋণ হিসাবকে (পুনঃতফসিলের ক্রম একই হওয়া সাপেক্ষে) একত্রিত করে একক ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিল করা যাবে।
শ্রেণীকৃত কোনো ঋণ এ প্রজ্ঞাপন জারির আগে চার বা ততোধিক বার পুনঃতফসিলকৃত হলে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ হিসাবটি সর্বশেষ একবার পুনঃতফসিল করা যাবে, যা চতুর্থ বার হিসেবে গণ্য হবে।
আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত এরূপ পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ থাকবে।
চতুর্থ বার পুনঃতফসিলীকরণের পরও কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাংককে আবশ্যিকভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাল-জালিয়াতি বা অন্য কোনো ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণের ক্ষেত্রে এসব সুবিধা প্রদান করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে সার্কুলারে।
মহামারি করোনার কারণে দেয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক খাতে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতি গতি ধরে রাখতে যে দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এই কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বন্যার কারণে এর আগেও ঋণখেলাপিদের অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে।