মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিনিময় হারের নড়বড়ে অবস্থার চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করলো বাংলাদেশ ব্যাংক। যেখানে মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিনিময় হারের উর্ধ্বমূখী চাপ নিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানালেন বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আসন্ন অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। এটি ছিল বর্তমান গভর্নর ঘোষিত শেষ মুদ্রানীতি। কারণ ৩ জুলাই রোববার তার শেষ কর্মদিবস। নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বর্তমান অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
করোনার অভিঘাতে নাকাল বিশ্ব অর্থনীতি। এর প্রভাবে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির জাতাঁকলে পড়েছে সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত কমছে টাকার মান। এই সংকটপূর্ণ অবস্থার মধ্যে দুই বছর পর আগামী অর্থবছরের জন্য সামনাসামনি মুদ্রানীতি ঘোষণা করলো বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। তবে বাড়ানো হয়েছে সরকারকে ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজারে মুদ্রার সরবরাহে লাগাম টানলেন গর্ভনর।
আসছে অর্থবছরে আমানতকারীদের জন্য সুদ হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, ঋণের একক ৯ শতাংশ সুদ হারেও কোনো চাপ নেই।
গর্ভনর হিসেবে এই শেষ মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন তার কাছে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্ন ছিলো, কতটুকু উপভোগ করেছেন এই পদ?
গভর্নর জানালেন, তার দায়িত্বকালীন এই ৬ বছরে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ করোনাসহ যেসব চাপ এসেছে তাতে তিনি খুব একটা স্বস্তি পাননি।
বিদায়ী গভর্নরের এই সময়কালে ঘুরে-ফিরে এসেছে ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য, একক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দেয়া কিংবা রাজনৈতিক চাপের মতো বিষয়গুলো।
গর্ভনরের দাবি, সব চাপ উপেক্ষা করেই স্বাধীনভাবে চলেছে আর্থিক খাত।
নতুন মুদ্রানীতি
মুদ্রা সরবরাহে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। এটা সরকারের কাঙ্ক্ষিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সিলিংয়ের সমষ্টির তুলনায় কিছুটা কম। আগের বছর অর্থ সরবরাহ নির্ধারণ করা হয় ১৫ শতাংশ।
মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ।
সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নীট ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ ঋণের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে।
বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধির সংকুলান রাখা হয়েছে।
গভর্নর বলেন, ‘২০২১-২২ অর্থবছরের মতো ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ব্যাংকিং খাতে নীট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঋণাত্মক হতে পারে। এছাড়া দেশের রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনা থাকলেও উচ্চ ভিত্তির কারণে এগুলোর প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের তুলনায় কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘২০২১-২২ অর্থবছরে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের অন্তঃপ্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে নীতি সুদহার হিসেবে বিবেচিত রেপো সুদ হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।’
তাছাড়া আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালুর কথা জানান তিনি।
মুদ্রানীতিতে দুই চ্যালেঞ্জ
গভর্নর বলেন, ‘ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল চ্যালেঞ্জ হবে টাকার মান ধরে রাখা। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সমর্থন অব্যাহত রাখা। এজন্য সতর্কতামূলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী।’
জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকারের কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হলো ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
ফজলে কবির বলেন, ‘মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ ধরে রাখা। আর কর্মসংস্থানের জন্য আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি চাই।’
বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সরকার বা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করছে না। অর্থনীতির জন্য যা প্রয়োজন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বিবেচনায় নিয়েই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়, কারও চাপে পড়ে নয়।’
একক সুদ হারে চাপ নেই
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও আমানতের হার সত্ত্বেও ঋণের সুদ ৯ শতাংশ অব্যাহত থাকবে বলে জানান গভর্নর ফজলে কবির।
তিনি বলেন, ‘ঋণের ৯ শতাংশ সুদ হারে এখন পর্যন্ত কোনো চাপ দেখছি না। পুরো ব্যাংক খাতে ঋণের গড় সুদ বর্তমানে ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। সুদ হার নির্ধারণের আগে ঋণের সুদ শুধু ডাবল ডিজিট নয়, ১৭ থেকে ১৮ শতাংশে উঠে যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এখনো কোনো চাপ অনুভব করছি না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সব ধরনের ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ করে।
গভর্নরের সময়ে কেমন ছিল ব্যাংক খাত
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘ব্যাংক খাতের অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি জয়েন করেছিলাম। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে স্বস্তি পাইনি। তবে আশা করছি আগামী রোববার থেকে সব ভালো জিনিস দেখব। ‘আমি ১১তম গভর্নর। আমলাদের মধ্যে সপ্তম গভর্নর আমি। এর বাইরে একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার, দুজন কমার্শিয়াল ব্যাংকার ও একজন ম্যাক্রো ইকোনমিস্ট ছিলেন। বাকি সবাই আমলা থেকেই গভর্নর হয়েছেন।’