বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ অবাধে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দিলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিদেশি শিল্প-উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফআইসিসিআই)।
পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগকে এফআইসিসি পাচারকারীদের ‘সাধারণ ক্ষমা’ হিসেবে অবিহিত করে বলেছে, ‘এই ধরনের ক্ষমাকে আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বিদেশে পাচার করা সম্পদ বা অর্থ ট্যাক্স রিটার্নে ঘোষণা দিয়ে দেশে কর পরিশোধ করে ফেরত আনতে চাইলে “সাধারণ ক্ষমা”র প্রস্তাব করেছেন। আমরা এই ধরণের “সাধারণ ক্ষমা”কে সমর্থন করি না। এটি আরও বেশি অর্থ বা টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে।’
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। তাতে বিদেশে অবস্থিত কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না।
বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি দেশে আনলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ কর বসানোর সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে এফআইসিসিআই এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে।
তবে বাজেটে অর্থমন্ত্রী কয়েকটি খাতে করপোরেট কর কমানোর যে প্রস্তাব করেছেন, তার প্রশংসা করে ফরেন চেম্বার বলেছে, ‘এর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বিবৃতিতে কঠিন এই পরিস্থিতিতে ‘বাস্তবসম্মত’ বাজেট দেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো হয়। বাজেট প্রস্তাবে এফআইসিসিআই-এর কিছু সুপারিশ বিবেচনা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। যা অবশ্যই ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করবে।’
ফরেন চেম্বারের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন বাহ্যিক ধাক্কা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে অশান্তি সত্ত্বেও অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারের সুবিধার্থে নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
‘সঠিকভাবে এই বাজেট বাস্তবায়ন হলে বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়বে। আর তাতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।’
এফআইসিসিআই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখায় বাজেটের প্রশংসা করেছে।
তবে মেগা প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংগঠনটি বলেছে, ‘এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বাস্তবায়ন ধীর হতে পারে। আমরা মনে করি মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর পরিবর্তে সরকার ব্যয়ের গুণমান বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
প্রস্তাবে বাজেটে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিশাল অংকের ঋণ গ্রহণের যে লক্ষ্য ধরেছে, তাতেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘এতে বেসরকারি খাত ঋণ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
‘আমরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কৃষি, খাদ্য ও মৎস্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করি, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
‘সামাজিক নিরাপত্তা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ একটি মহান উদ্যোগ। কারণ বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সক্ষমতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
প্রস্তাবিত বাজেটের আরও কিছু প্রস্তাব সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই সংগঠন। সেগুলো হচ্ছে ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে প্রদেয় অনুদানকে ব্যয় হিসেবে অগ্রাহ্য করা, মোবাইল ফোন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিলে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা ইত্যাদি।
এফআইসিসিআই-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে প্রদেয় অনুদানকে ব্যয় হিসেবে অগ্রাহ্য করা হলে তা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার উপর চাপ তৈরি করবে। অন্যদিকে মোবাইল ফোন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিলে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হলে তা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে।’
আয়কর সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রস্তাবকে ইতিবাচক মনে করছে সংগঠনটি। এগুলো হচ্ছে করপোরেট কর হার হ্রাস, রপ্তানিমুখী সকল শিল্পখাতে ১২ শতাংশ করপোরেট কর নির্ধারণ, সবুজ কারখানায় ১০ শতাংশ কর ধার্য, একীভূতকরণের সংজ্ঞা পরিবর্তন ইত্যাদি।