২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা এবং নিরাপদ ও টেকসই জ্বালানি নিশ্চিতের কথা বলা হলেও নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কমেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’-এর বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি, যা বৰ্তমান ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিলো ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।’
সে হিসাবে এই দুই খাতে বরাদ্দ কমেছে ৫ শতাংশের বেশি, অংকের হিসাবে এক হাজার ৪১৮ কোটি টাকা।
তবে সংশোধিত বাজেটকে হিসাবে নেয়া হলে, দেখা যায় বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ শেষপর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ এখনও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অংশ হিসেবে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ জ্বালানির সংস্থান নিশ্চিতের স্বপ্নও দেখছেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, এ জন্য ৮ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে চারটি বাতিল করা হয়েছে। বাকি ছয়টিকে নবায়নযোগ্য বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে দেশে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশবান্ধব করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এর ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৮ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
‘এ ১০টি প্রকল্পের মধ্যে ৪টি বাতিল করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ছয়টিকে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য অথবা গ্যাসভিত্তিক করা হবে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আমাদের ৪০ শতাংশ জ্বালানির সংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে বাংলাদেশ নেয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা এবং নিরাপদ ও টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘গত ১৩ বছর ধরে বিদুৎ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে দেশে সম্প্রতি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।’
বর্তমান সরকারের ১৩ বছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ থেকে ৫৬০ কিলোওয়াট আওয়ারে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এ সময়কালে ৫ হাজার ২১৩ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন এবং ৩ লাখ ৩৬ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণে সিস্টেম লস ১৪ শতাংশ হতে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।’
বর্তমানে দেশে ১৩ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘জমির প্রাপ্যতা, জ্বালানি পরিবহন সুবিধা এবং লোড সেন্টার বিবেচনায় পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকাকে পাওয়ার হাব হিসেবে চিহ্নিত করে বৃহৎপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শেষে কয়লাভিত্তিক রামপাল এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রজেক্ট, মাতারবাড়ি এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিকাল কোল প্রজেক্ট স্থাপনের কাজ পুরোদমে চলছে বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। পাশাপাশি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে প্রায় ৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
‘মোট চাহিদার শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদনের লক্ষ্যে সৌর শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে এ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে অচিরেই দেশের সব মানুষের জন্য মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে পায়রা-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন এবং গোপালগঞ্জ-রামপাল ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনদুটির নির্মাণ কাজ শেষে কমিশনিং করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘মোংলা-খুলনা (দক্ষিণ) ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে। গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের ৭.৫ কিমি পদ্মা রিভার ক্রসিং অংশের পদ্মা রিভার বেডের সাতটি টাওয়ারের ফাউন্ডেশনের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশনের জন্য ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি ভোল্টেজের ছয়টি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।’
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি জ্বালানির চাহিদাও দ্রুতগতিতে বাড়ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যার একটি বড় অংশ মূলত প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।’
দেশে আবিষ্কৃত ২৮টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টিতে উৎপাদন চলছে বলেও জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে দেশে দৈনিক এক হাজার ৭৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো যা বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে।’
গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দৈনিক প্রায় ৬০০-৭৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের শোধন ক্ষমতা আরও ৩০ লাখ টন বাড়াতে ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে।’