পাহাড়সম বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে অর্থনীতি।
আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ায় উঠেছে।
চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন (২ হাজার ৭৫৭ কোটি) ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৯ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) চেয়েও ২১ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-এপ্রিল সময়ের চেয়ে বেশি প্রায় ৫৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
গ্রাফিক্স: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা
এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরে এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি বাংলাদেশ। আর এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে; অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ে মাত্র ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।
পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে বাংলাদেশ এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও মঞ্জুর হোসেন।
তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে অর্থনীতি।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; তারপরও তেমন আমদানি কমছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে রপ্তানি আয় কমলেও আমদানি কমার কোনো লক্ষণ দেয়া যাচ্ছে না। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে সংকট ততই বাড়ছে।
গ্রাফিক্স: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি ৯০ লাখ (৬৮.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ৪৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
এ হিসাবেই অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতিও বাড়ছে
জুলাই-এপ্রিল সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১৫.৩১ বিলিয়ন ডলার
২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। দিন যত যাচ্ছে, ঘাটতি ততই বাড়ছে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি ৪০ লাখ (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারি শেষে ১০ দশমিক শূন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
গ্রাফিক্স: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা
ফেব্রুয়ারি শেষে তা ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। মার্চ শেষে ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আর সবশেষ এপ্রিল শেষে তা ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের চূড়ায় উঠেছে। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বিশাল ঘাটতিতে পড়েনি বাংলাদেশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই সূচকে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমায় ৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
আর্থিক হিসাবে এখনও বড় উদ্বৃত্ত
তবে আর্থিক হিসাবে এখনও বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানান আহসান মনসুর।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তবে জুলাই-এপ্রিল সময়ে সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
রেমিট্যান্স কমেছে ১৭.৭৪ শতাংশ
জুলাই-এপ্রিল সময়ে ১৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
গ্রাফিক্স: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা
যে কারণে আমদানিতে উল্লম্ফন
করোনার পর সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। সেই চাহিদার কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। সবশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আরও চড়ছে দাম। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে নতুন উচ্চতায় উঠেছে।
গত বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার। রোববার সেই তেল ১১৩ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে এর দর ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, ৯৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। শিল্পে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
মহামারির পর চাহিদা বাড়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ছাড়াও খাদ্যপণ্য (বিশেষ করে গম), ভোজ্যতেল, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বেড়েছে। এখনও বেড়েই চলেছে।
গত বছরের মার্চে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ ডলার। বর্তমানে এই তেল ১ হাজার ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে মোট আমদানি ব্যয়ের ৭০ শতাংশের মতো খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও অন্য পণ্য আমদানিতে। একই সঙ্গে এ খাতে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিও বেড়েছে।
তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। গত বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ কাউন্ট মানের সুতার দাম ছিল ৩ ডলারের মতো। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ৪ দশমিক ২০ থেকে ৪ দশমিক ৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। এখন তা ৪ দশমিক ১০ থেকে ৪ দশমিক ১৫ ডলারে নেমেছে।
নানা উদ্যোগেও কমছে না আমদানি
করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর থেকেই আমদানিতে উল্লম্ফন শুরু হয়। যা এখনও অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। এতে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে।
আমদানির লাগাম টানতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপেও কাজ হচ্ছে না। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে আমদানি খরচ।
অস্বাভাবিক এই আমদানির লাগাম টেনে ধরতে বিলাসপণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত এলসি মার্জিন আরোপসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও তেমন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বেড়েই চলেছে আমদানি। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সামাল দিতে সবশেষ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দফায় এক ধাক্কায় টাকার মান ১ টাকা ১০ পয়সা কমিয়ে সব ব্যাংকের জন্য ডলারের একক দর ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
কিন্তু বাজারে ডলারের সংকট বেড়ে যাওয়ায় সেই সিদ্ধন্ত থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের লেনদেন (আন্তব্যাংক লেনদেন) ফের ব্যাংকগুলোর ওপরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সেইসঙ্গে সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দফায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৯০ পয়সা কমিয়ে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ কেরা হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে আট দফা কমানো হলো টাকার মান। আর এক বছরে টাকার মান কমেছে ৬ শতাংশ।
আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৭ এপ্রিল। ওই দিন এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়।
এরপর ১০ মে বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করে আরেকটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সার্কুলারে বলা হয়, সকল ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।
একই সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নেয় সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় ২০০ বিলাস পণ্যের আমদানির ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।
এসব পদক্ষেপের বেশির ভাগই নেয়া হয়েছে চলতি মাসে। সে হিসেবে মে মাসের আমদানির তথ্য পাওয়া গেলে বোঝা যাবে আমদানি কমার ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ কতটা কাজে দিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ডলারের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৬ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়ায় তারপরও চাহিদা মিটছে না।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৪৫ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ব আমরা।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদ্যুতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি কমাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসবেও যদি আমদানি না কমে তাহলে কিন্তু উদ্বেগের বিষয়। যে করেই হোক আমাদের আমদানি অনেক কমাতে হবে। কেননা, রেমিট্যান্সের পাশপাশি রপ্তানি আয়ও কিন্তু কমতে শুরু করেছে। এখন প্রয়োজনে হলে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে হলেও আমদানি কমাতে হবে।’
একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ এদন এই অর্থনীইতিবদ।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘রপ্তানি অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতেই হবে আমাদের। এখন বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি না হয়, সেদিকে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানি আয় ৩৪ শতাংশ বাড়লেও মে মাসে বড় ধাক্কা খেয়েছে। এই মাসে ৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। যা গত ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে এই ১১ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ শতাংশ।
রিজার্ভ ৪২.১০ বিলিয়ন ডলার
বৃহস্পতিবার দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ২১০ কোটি (৪২.১০ বিলিয়ন) ডলার।
আমদানি ব্যয় বাড়ায় গত ৯ মে আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) রেকর্ড ২২৪ কোটি (২.২৪ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর সপ্তাহখানেক রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করে। মাঝে তা বেড়ে ৪২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
কিন্তু বর্তমানে তা কমে ৪২.১০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ- প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। এ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
মূল্যস্ফীতির পারদও চড়ছে
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবেই এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির পারদ ৬ দশমিক ২৯ উঠেছে। যা ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের এপ্রিলে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ২৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারি থেকে তা আবার বাড়ছে।
তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।
একই কথা বলেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিস্ময়কর। এটা দেশের কোনো মানুষই বিশ্বাস করে না।’