শেষ সময়ের চমকে টানা চতুর্থ দিন সূচক বেড়ে পুঁজিবাজার স্বস্তি দিল বিনিয়োগকারীদের। অথচ লেনদেন এক পর্যায়ে সূচকের পতনের আভাস দিয়ে চলছিল লেনদেন।
গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে সূচক বাড়ল ২০৫ পয়েন্ট।
এমনিতেই সংশোধনে থাকা পুঁজিবাজার ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ডলারের দাম বৃদ্ধি আর নানা গুজবে টালমাটাল পুঁজিবাজারে এই উত্থান বিনিয়োগকারীদেরকে মনে চিড় ধরা আস্থায় কিছুটা হলেও মলম দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
একক খাত হিসেবে টানা দ্বিতীয় দিন সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করেছে ব্যাংক খাত। আর শেয়ারদর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বিমা খাতে।
গত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বাজার সংশোধন এবং পরে ইউক্রেনে রুশ হামলার দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ধসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিমার শেয়ারধারীরা। এই কয়েক মাসে এই খাতের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।
এই খাতটি নিয়ে হতাশার মধ্যেই হঠাৎ করেই দল বেঁধে বাড়ে প্রায় সব শেয়ারের দর। বিমার মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সাধারণ বিমার দর। এই খাতের ৩৯টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৮টির। কমেছে কেবল একটির, যে কোম্পানিটির শেয়ারদর গত কয়েক মাসে কমেনি।
আরও একটি কোম্পানির শেয়ারদর সবচেয়ে দরপতন হওয়া কোম্পানির তালিকায় শীর্ষে দেখালেও প্রকৃতপক্ষে লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার পর দর সমন্বয় হয়েছে। এই হিসাব করে দেখা যায়, কোম্পানিটির দর আসলে বেড়েছে।
মঙ্গলবার সূচক বেড়েছে শেষ আধা ঘণ্টার চমকে। বেলা দুইটা পর্যন্ত বাজারে ছিল নেতিবাচক প্রবণতা। তবে এর পরের ৩০ মিনিটে ফেরে চাঙাভাব
আগের দিন দল বেঁধে চাঙা হওয়া ব্যাংক খাতে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির দর। যদিও দর বৃদ্ধি ও হ্রাসের মধ্যে টাকার অঙ্কে পার্থক্য খুবই কম।
এর মধ্যে একটি কোম্পানির দর লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার কারণে সমন্বয় হয়েছে। এটির দর ২০ পয়সা কমতে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষ দর বেড়েছে।
সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর পর বেলা সোয়া ১২টা পর্যন্ত ২০ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হতে থাকলেও বেলা দুইটার সময় আগের দিনের চেয়ে সূচক কমে যায় ২০ পয়েন্ট। অর্থাৎ দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে পৌনে দুই ঘণ্টায় সূচক হারায় ৪০ পয়েন্ট।
টানা দিন দিন বাড়ার পর অস্থির পুঁজিবাজারে বিক্রয়চাপ দেখা দেয়ায় আরও পতন হয় কি না, এ নিয়ে জিজ্ঞাসার মধ্যে হঠাৎ দেখা দেয় ইউটার্ন। পৌনে এক ঘণ্টায় যতটা পড়েছিল, শেষ আধা ঘণ্টায় প্রায় ততটাই উঠে যায় সূচক।
লেনদেন শেষের আগের মিনিটে আগের দিনের চেয়ে সূচক বেড়ে যায় ১৬ পয়েন্ট। তবে শেষ সময়ের সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ে ৪ পয়েন্ট।
শেষ সময়ের ক্রয়চাপের পরও লেনদেনে দেখা গেছে ভাটা। গত মার্চে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা দুই শতাংশ নির্ধারণের পর লেনদেনে ভাটার যে চিত্র দেখা গিয়েছিল, সেটিও ফিরে এসেছে। দুই শতাংশ বা কাছাকাছি দর কমার পর বহু কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতা উধাও হয়ে গেছে। এ কারণে ভাটা দেখা গেছে লেনদেনে।
সোমবার পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছিল ৮৩৬ কোটি ৪০ লাখ ১৭ টাকা। সেটি প্রায় ২০০ কোটি টাকা কমে হয়েছে ৬৩৭ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার টাকা।
বেলা শেষে বেড়েছে ১৩৭ কোম্পানির দর, কমেছে ১৯৬টির, আর অপরিবর্তিত থাকে ৪৩টির দর।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এক্সপো ট্রেডার্সের সিইও শহিদুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার তিন দিন উত্থানের পরে আজকে সেল প্রেসার ছিল। কারণ, গত তিন দিনে কিনে যারা প্রফিট করতে পেরেছেন, তারা প্রফিট-টেকিং করেছেন। যার জন্য বাজার কিছুটা নিম্নমুখী ছিল।’
স্টক ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন-ডিবিএর সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার আসলে অনেক পড়ে গিয়েছিল। সরকারের দিক থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সে কারণে কয়েকদিন ধরে বাজার একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে আতঙ্ক একটু হলেও আছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। যে কাজটি সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেটি হলো আস্থা ফেরানো। বাজারে নানা গুজব এখনও আছে। সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’
বিমায় দারুণ দিন
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৮টিই ছিল এই একটি খাতের। অন্য খাতগুলোর মধ্যে ছিল খাদ্য খাতের রহিমা ফুড, যে কোম্পানিটি আজ থেকে কাজু বাদাম বাজারজাত করা শুরু করেছে এবং বস্ত্র খাতের সোনারগাঁও টেক্সটাইল।
রহিমা ফুড কোম্পানিটি বেশ কয়েক বছর ধরে ছিল বন্ধ। সিটি গ্রুপের মালিকানায় যাওয়ার পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নারকেল তেল উৎপাদন শুরু করার কথা জানায় কোম্পানিটি। সেই সঙ্গে সয়াবিন ও সরিষার তেল বাজারজাত করা হবে বলে জানানো হয়।
মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকায় বিমা খাতের প্রাধান্য দেখা গেছে
এই ব্যবসায় নামার গুঞ্জনেই কোম্পানিটির শেয়ারদর গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছিল। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর শেয়ারদর ৩৮৭ টাকা থেকে নামতে নামতে ২২০ টাকায় চলে আসে। তবে রোববার থেকে আবার টানা বাড়ছে এবং এবার কাজু বাদাম ব্যবসায় নামার খবরে আরেক দফা বাড়ল।
অন্যদিকে সোনারগাঁও টেক্সটাইল গত দুই বছর ধরে লোকসান দেয়ার পর এবার মুনাফায় ফিরেছে। গত বছর কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ১৩ টাকার বেশি লোকসান দিয়েছিল। চলতি বছর তৃতীয় প্রান্তিক শেষে মুনাফা হয়েছে শেয়ার প্রতি ২৪ পয়সা।
সবচেয়ে বেশি অবশ্য বেড়েছে সোনারবাংলা ইন্স্যুরেন্সের দর। যেটি তার সর্বোচ্চ অবস্থান ১২১ টাকা থেকে ৪৬ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে এসেছিল। সেখান থেকে ৯.৯৩ শতাংশ বেড়ে বর্তমান দাম ৫০ টাকা ৯০ পয়সা।
এছাড়া ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের দর ৮.৩৭ শতাংশ, সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের দর ৮.০২ শতাংশ, জনতা ইন্স্যুরেন্সের দর ৭.৮২ শতাংশ, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের দর ৭.৪৪ শতাংশ, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের দর ৬.৯৭ শতাংশ, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের দর ৬.৬৬ শতাংশ, এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ৬.৫৭ শতাশং।
আরও দুটি কোম্পানির দর ৬ শতাংশের বেশি, ৯টির দর ৫ শতাংশের বেশি, ১২টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১২টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ২৭টির দর বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।
এসব কোম্পানির মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিমা খাতের।
সূচক বাড়াল যারা
কেবল ১০টি কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ২০.৯১ পয়েন্ট। এই ১০টি কোম্পানির মধ্যে ব্যাংক খাতেরই আছে পাঁচটি, যেগুলো যোগ করেছে ৯.০৭ পয়েন্ট। আগের দিনও ব্যাংকের শেয়ারে ভর করে বেড়েছিল সূচক।
এসব কোম্পানির মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ৩.৭৩ পয়েন্ট যোগ করেছে বেক্সিমকো ফার্মা। কোম্পানিটির দর ১.৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩.২৩ পয়েন্ট যোগ করেছে ইউনাইটেড পাওয়ার। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ০.৭৩ শতাংশ।
সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করেছে যে ১০টি কোম্পানি, তার মধ্যে ব্যাংক খাতেরই ছিল পাঁচটি
ব্যাংকের মধ্যে এনবিএলের দর ২.৭৪ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকের দর ১.২৫ শতাংশ বাড়ার কারণেও ২ পয়েন্ট করে, আল আরাফাহ ব্যাংকের দর ২.৩১ শতাংশ বাড়ার কারণে ১.৯৮ পয়েন্ট, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের দর ৫.৯৮ শতাংশ বাড়ার কারণে ১.৭৭ পয়েন্ট এবং সিটি ব্যাংকের দর ১.৭১ শতাংশ বাড়ার কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ১.৩২ পয়েন্ট।
এছাড়া বেক্সিমকো সুকুকের দর ২.৩৩ শতাংশ বাড়ার কারণে ১.৮৬ পয়েন্ট, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর দর ০.১৮ শতাংশ বাড়ার কারণে ১.৬৭ পয়েন্ট এবং পদ্মা অয়েলের দর ২.১৭ শতাংশ বাড়ার কারণে ১.৩৭ পয়েন্ট যোগ হয়েছে সূচকে।
অন্যদিকে সূচক সবচেয়ে বেশি ৬.১ পয়েন্ট টেনে নামিয়েছে ওয়ালটন। কোম্পানিটির শেয়ারদর ০.৬০ শতাংশ কমার কারণে এই পরিমাণ সূচক কমেছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪.৮৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে রবির শেয়ারের ১.০১ শতাংশ দরপতনে। বেক্সিমকো লিমিটেডের ০.৮৮ শতাংশ দাম কমায় সূচক কমেছে ৩.২৬ পয়েন্ট।
এছাড়া বার্জার পেইন্টসের দরপতনে ২.৮ পয়েন্ট, আইসিবির দরপতনে ২.৭৫ পয়েন্ট, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের দরপতনে ২.৫২ পয়েন্ট, গ্রামীণ ফোনের দরপতনে ১.৬৭ পয়েন্ট, ব্র্যাক ব্যাংকের দরপনে ১.৩৯ পয়েন্ট, রেনাটার দরপতনে ১.২৩ পয়েন্ট ও আইপিডিসির ১.৮৭ শতাংশ দরপতনে সূচক কমেছে ১.১৫ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক কমেছে ২৭.৭৪ পয়েন্ট।
লেনদেনে ফের ২ শতাংশের বাধা
গত মার্চেও এই চিত্র দেখা দিয়েছিল। এই বাধা উঠিয়ে নেয়ার পর ২১ এপ্রিল থেকে লেনদেন বাড়তে থাকলেও ক্রমাগত দরপতনের কারণে আবার এক দিনে কোনো শেয়ারের দাম কমার সর্বোচ্চ হার ২ শতাংশ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে এই নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে সূচক বাড়ছে। তবে লেনদেনে দেখা দিয়েছে ভাটা।
এই সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত দাম কমার পর ৪০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতা শূন্য হয়ে যায়। দাম আরও পড়ে যায় কি না, এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে।