পতনমুখী পুঁজিবাজারকে টেনে তুলতে দেয়া একগুচ্ছ সিদ্ধান্তও বাজারে আস্থা ফেরাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নানা ঘোষণায় যে উত্থান হয়েছিল, সেটি টিকল না এক দিনও।
সোমবার ১১৮ পয়েন্ট সূচক বাড়ার সুখস্মৃতি নিয়ে লেনদেন শুরু করা পুঁজিবাজারে মঙ্গলবার পতন হলো ৫০ পয়েন্ট।
লেনদেন শেষ হওয়ার দুই মিনিট আগেও সূচক পড়ে যায় ৭১ পয়েন্ট। তবে শেষ সময়ের সমন্বয়ে এই সূচক সেখান থেকে ২১ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন।
গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বড় দরপতনে যে চিত্র প্রতিদিন দেখা গেছে, সেটি দেখা গেল আবার। এদিনও একপর্যায়ে সূচক বেড়ে গিয়ে আশা তৈরি করে পরে হতাশ করেছে বিনিয়োগকারীদের।
শেয়ারদর ও সূচকের পতন হয়েছে মূলত শেষ সময়ে, যাতে বোঝা যায়, দেড় দিনের উত্থানের সুযোগে মুনাফা তুলে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে, এমন আশায় শেয়ার ধরে না রেখে যে মুনাফা হয়েছে, সেটিই নিয়ে নিয়েছেন তারা।
১১৮ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির পর দিন শেয়ারদর আরও বেড়েও পরে শেষ বেলায় কমে যায় অনেকটাই
ঈদের অবসর শেষে টানা আট কর্মদিবসে ৫৫৫ পয়েন্ট সূচকের পতনের পর রোববার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে।
বৈঠকে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দেন মন্ত্রী। সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে ব্যাংকগুলো আইসিবির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করবে, সেটাকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমার (এক্সপোজার লিমিট) বাইরে রাখা হবে।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইসিবিকে দেয়া ১৫৩ কোটি টাকার যে তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটির মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তহবিলের আকারও বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করা হবে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার নির্দেশও দেন মন্ত্রী।
এই বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় সোমবার ১১৮ পয়েন্টের উত্থান হলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে শঙ্কা রয়ে গিয়েছিল, সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় লেনদেনেই। বাজারে সক্রিয় না হয়ে আরও অপেক্ষার নীতি নেয়ায় লেনদেন কমে যায় অনেকটাই।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার নিয়ে আর কী বলব, কিছুই বলার নাই। কী বলব বুঝতে পারছি না। এত সাপোর্ট, এত কিছু- ভেবেছিলাম বাজার এবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু একদিন বেড়েই আবার সেই পতন। কিছুই বলার নেই।’
সূচক পতনের দিন লেনদেন আগের দিনের চেয়ে কিছুটা বাড়ে। আগের দিন লেনদেন ছিল ৬৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। সেটি হয়েছে ৬৬০ কোটি ৪৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
আগের দিন প্রায় সাড়ে ৩০০ কোম্পানির দর বাড়লেও আজ কমে যায় পৌনে ৩০০ কোম্পানির দর।
দিন শেষে বাড়ে ৫৫টির দর, কমে যায় ২৭৮টির আর দর অপরিবর্তিত থাকে ৪৩টির।
এর মধ্যে সিরামিকস, চামড়া, টেলিযোগাযোগ, ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের সব শেয়ারই দর হারিয়েছে।
প্রধান খাতগুলোর মধ্যে ওষুধ ও রসায়ন খাতে দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা। বাকি সব খাতেই দর হারিয়েছে সিংহভাগ কোম্পানি।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের ১৩টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে দর কমেছে ১৬টির।
প্রধান অন্য খাতগুলোর মধ্যে বস্ত্রে ৪টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৫০টির দর, প্রকৌশণ খাতে ৬টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে ৩৪টি, সাধারণ বিমায় ৫ টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে ৩২টি, জীবন বিমায় ৩টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে ৯টির, খাদ্য খাতে ৩টির বিপরীতে ১৮টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩টির বিপরীতে ২০টি, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ৪টির বিপরীতে ২০টি, বিবিধ খাতে ২টির বিপরীতে ১২টি, ব্যাংক খাতে ৬টির বিপরীতে ১৪টি, আর্থিক খাতে ৩টির বিপরীতে ১৩টি, তথ্য প্রযুক্তিতে একটির বিপরীতে ১০টি, সিমেন্টের একটির বিপরীতে ৫টি, সেবা ও আবাসনে একটির বিপরীতে ৩টির দর কমেছে।
ফের ঢালাও পতন
দর পতনের শীর্ষ তালিকায় সোনালী পেপার দেখালেও প্রকৃতপক্ষে এই কোম্পানিটির দর প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদেরকে প্রতি দুটি শেয়ারের বিপরীতে একটি করে রাইট শেয়ার দিয়েছে, যার রেকর্ড ডেট ছিল সোমবার।
রেকর্ড ডেটে দর ছিল ৭২৮ টাকা ২০ পয়সা। দুটি শেয়ারে অভিহিত মূল্যে একটি রাইট শেয়ার দিলে একেকটি শেয়ারের দর দাঁড়ায় ৪৮৮ টাকা ৮০ পয়সা। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ৫৩১ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ দর বেড়েছে ৮.৭৩ শতাংশ।
এদিন সব মিলিয়ে ১৫টির মতো কোম্পানি দিনের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা পাঁচ শতাংশ বা কাছাকাছি কমে লেনদেন শেষ করেছে।
আরও ১৩টি কোম্পানির দর ৪ শতাংশের বেশি, ৩২টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৬৭টির দর ২ শতাংশের বেশি কমেছে।
বিপরীতে একটি কোম্পানিও দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া সিলকো ফার্মার দর বেড়েছে ৬.৮৫ শতাংশ।
এর বাইরে দুটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৪টির দর ৪ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৩ শতাংশের বেশি, তিনটির দর ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
সূচকের পতন যাদের কারণে
সূচক সবচেয়ে বেশি ৫.৯৩ পয়েন্ট কমিয়েছে ওয়ালটন। কোম্পানিটির দর কমেছে ১.৬২ শতাংশ। সোনালী পেপারের রাইট শেয়ারের সঙ্গে দর সমন্বয়ে সূচক কমেছে ৪.৭৭ পয়েন্ট। গ্রামীণ ফোনের দর ০.৮৫ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ৩.৮৮ পয়েন্ট।
এছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো ২.১৫ পয়েন্ট, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট ২.০৫ পয়েন্ট, বেক্সিমকো ফার্মা ১.৯৭ পয়েন্ট, বেক্সিমকো লিমিটেড ১.২৬ পয়েন্ট, ও বিএসআরএম স্টিল ০.৯১ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে।
সব মিলিয়ে সূচক যতটা কমেছে, তার অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ২৬ পয়েন্টই কমিয়েছে এই ১০টি কোম্পানি।
অন্যদিকে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে, এমন একটি কোম্পানিও এক পয়েন্ট বাড়াতে পারেনি। সব মিলিয়ে ১০টি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে বাড়াতে পেরেছে ৪.১১ পয়েন্ট।