পাচার হয়ে যে টাকা দেশের বাইরে গেছে তা ফেরত আসবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিদেশে টাকা রেখে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি।’
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯-২০’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এমন সুবিধা দেব, যাতে সবাই টাকা নিয়ে ফিরে আসেন।’
সভায় বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা কমাতে ব্যাংকগুলোকে একক দাম বেঁধে দেয়ার দাবি জানান ব্যাংকাররা। যদিও তা উড়িয়ে দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
তিনি জানান, বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্যের অস্থিরতায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। তাই এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য বৈধপথে প্রবাসী আয় আহরণ।
অনুষ্ঠানে ২০১৯ ও ২০২০-এর জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৬৭টি পুরস্কার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যক্তিপর্যায়ে তিন ক্যাটাগরিতে এ পুরস্কার দেয়া হয়। এগুলো হলো সাধারণ পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী।
এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহকারী ব্যাংক ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসীদের মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউস এই দুই ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা হয়।
২০১৯ এবং ২০২০ সালে ব্যক্তিপর্যায়ে সাধারণ পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে ৫৩ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
সপ্তমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ আয়োজন করেছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হচ্ছে তা জানা থাকলেও উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।’
এর আগেও পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে পাচার অর্থ ফেরত আনা বা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কোনো কর্তৃপক্ষকে। আদালত কয়েকজনকে শাস্তি দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির ৩৪ শতাংশ। আমাদের কোনো হার্ড লোন নেই, সব সফট লোন। আমাদের শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মেলানো যাবে না।’
অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠালে কোনো না কোনো সময় প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তাই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুরোধ করেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমেরিকা, ইউরোপের অনেক দেশে এখন টাকা রাখলে কমিশন দিতে হয়। এখন আর সুদ পায় না। তাই যেকোনো উপায়েই হোক বাংলাদেশে টাকা চলে আসবে। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় টাকা রাখলে বেনিফিট পাওয়া যায়।’
অনুষ্ঠানের প্রবাসীরা ওয়েজ আর্নার বন্ডের বিনিয়োগ সীমা বাড়ানোর দাবি জানালে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। আশা করছি প্রবাসীদের স্বার্থে ইতিবাচক সাড়া পাব। আপনারা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। আমরা আপনাদের সাপোর্ট দেব, আপনারা দেশকে সাপোর্ট দেবেন।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘হুন্ডি বাড়ছে, এই কথা ঠিক নয়। বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্যের অস্থিরতায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। তাই এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য বৈধপথে প্রবাসী আয় আহরণ। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
অনুষ্ঠানে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা কমাতে ব্যাংকগুলোকে একক দাম বেঁধে দেয়ার দাবি জানান ব্যাংকাররা। যদিও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেননি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর।
অনুষ্ঠানে ব্যাংকাররা বলেন, করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় হুন্ডির প্রবণতা বেড়েছে। খোলাবাজারে ডলারের বিপরীতে বাড়তি অর্থ পাওয়ায় অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অবৈধ পথ। পরিস্থিতির লাগাম দিতে তাই এক দেশ একক ডলারের রেট বেঁধে দেয়ার দাবি তাদের।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন বলেন, ‘রেমিট্যান্স ব্যবস্থায় এক্সচেঞ্জ রেট গুরুত্বপূর্ণ। সারা দেশের সব ব্যাংক এক রেট করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংককে বললে তারা বলে বাফেদাকে বলেন, কিন্তু বাফেদার কথা কে শুনবে, এরা তো সংগঠন৷ সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংককেই এ বিষয়ে নিদের্শনা দিতে হবে।
‘ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডি রেট বেশি দিলে ব্যাংকে টাকা পাঠায় না। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রেট দিলে আমরা পরিপালন করি, অন্য যারা করছে না তারা রেমিট্যান্স বেশি পায়। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাই যেকোনো নিয়ম করলে যাতে সবাই পরিপালন করে সেই ব্যবস্থা করা উচিত।’
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমদানি চাহিদা বাড়ছে, রেমিট্যান্স কমেছে। রেমিট্যান্সের সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। কিছু ব্যাংক আগ্রাসী রেট ধরে দিচ্ছে। এটায় মিডল ম্যান লাভবান হচ্ছে, প্রবাসীরা হয় না। সব ব্যাংকে এক রেট হওয়া উচিত।
‘করোনার দুই বছরে বিশ্ব যখন টালমাটাল, তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখছে প্রবাসী আয়। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি। তবে তা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশের বেশি কম।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।
বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০১৪ সাল থেকে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানো ব্যক্তি ও সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হচ্ছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী হিসেবে মোট ১৯৯ জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার দেয়া হয়।