এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করার পর লেনদেন ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। টানা চার দিন বেড়ে এক দিন সূচক কমার দিন কেবল কমেছে লেনদেন।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যত টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, চলতি রমজান মাসে এর আগে তা কখনও হয়নি। লেনদেন বাড়তে থাকাকে বাজারের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর হতাশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবার আশা তৈরি হচ্ছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বাজার সংশোধনে কখনও কখনও সূচক বেড়েছে টানা কয়েক দিন। এরপর আবার সংশোধনে গিয়ে টানা পড়তে থাকার প্রবণতা দেখা গেছে।
তবে রমজানের শুরুতে ধস পরিস্থিতি থেকে গত সপ্তাহে পুঁজিবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেখা গেছে। চলতি সপ্তাহে দেখা গেছে ব্যতিক্রম এক চিত্র। দুই সপ্তাহ মিলিয়ে টানা চার কর্মদিবস বাড়ার পর সূচক কমেছিল এক দিন। এবার সংশোধন এই এক দিনেই শেষ হয়েছে।
সোমবার সূচক সামান্য কমলেও মঙ্গলবারই ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। পরদিন বুধবার দিনভর উঠানামা করতে করতে বেলা শেষে প্রায় আগের দিনের অবস্থানেই শেষ হয় লেনদেন। সূচক বাড়ে কেবল ০.০৭ পয়েন্ট।
এদিন বাজারের ইতিবাচক প্রবণতা যেটি দেখা গেছে, সেটি হলো লেনদেন। দুই সপ্তাহ আগে যেটি চার শ কোটি টাকার নিচে নেমে গিয়েছিল, সেটি এখন নয় শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে আবার হাজার কোটি টাকার দিকে ছুটছে।
বেলা শেষে ৯৩২ কোটি ৪৯ লাখ ৩২ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যা রোজায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ঈদের আগে কেবল আর একটি কর্মদিবস আছে। বৃহস্পতিবার সেটি এক হাজার কোটি টাকা ছড়ায় কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
গত ২৪ এপ্রিল ৮৯৫ কোটি ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা ছিল রোজার সর্বোচ্চ লেনদেন। আর মাসটির প্রথম কর্মদিবস ৩ এপ্রিল লেনদেন ছিল ৮৩৬ কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বাজারে যে ধস নামে, সেটি ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ ঠিক করে দিয়েছিল মার্চে। শুরুতে এটি বাজারে পতন ঠেকাতে পারলেও পরে এটিই লেনদেন কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
ঈদের আগে আগে লেনদেনের এই চাঙাভাব বিনিয়োগকারীদেরকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে
পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির দুই শতাংশ দরপতন খুবই স্বাভাবিক একটি চিত্র। নানা সময় দেখা যায়, এর চেয়ে বেশি দর কমার পর সেদিনই ক্রয়চাপে আরও দাম বেড়েছে। কিন্তু দুই শতাংশের এই বিধানের কারণে দেখা যায়, দুই শতাংশ দর কমে যাওয়ার পর ক্রেতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন দরপতন ঘটতে থাকে।
গত ২০ এপ্রিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করার পরদিন থেকেই লেনদেনে দেখা যায় ইতিবাচক প্রবণতা।
আদেশ আসার পর প্রথম কর্মদিবস ২১ এপ্রিল লেনদেন দেড় শ কোটি টাকা বেড়ে হয় ৭৫৪ কোটি ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। পরের কর্মদিবস ২৪ এপ্রিল লেনদেন আরও বেড়ে হয় ৮৯৫ কোটি ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
এই দুই দিন মিলিয়ে মোট চার কর্মদিবস সূচক বাড়ার পর ২৫ এপ্রিল বাজার সংশোধনে লেনদেন এক দিন কমে হয় ৫৯৩ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
তবে সংশোধন কাটিয়ে পরের দিনই লেনদেন এখান থেকে দেড়শ কোটি টাকা বেড়ে হয় ৭৬৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
সেখান থেকে আরও ১৬৫ কোটি ৭৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা বাড়ল লেনদেন।
এদিন বেড়েছে বেশিরভাগ শেয়ারের দরও। সব মিলিয়ে ১৭১টি কোম্পানির দর বেড়েছে, কমেছে ১৫৮টির, আর অপরিবর্তিত ৫২টির দর ছিল অপরিবর্তিত।
স্টক ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের আগে বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ না থাকায় সেল প্রেসারটা ছিল না। লেনদেনও বেড়েছে। ঈদের পরে সেল প্রেসার থাকার কথা নয়, আশা করা যাচ্ছে বাজার সার্বিক অবস্থা তখন ভালো হবে।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে আবারও লোকসানি প্রতিষ্ঠান ইমাম বাটন। ২০১০ সালের পর থেকে কখনও লভ্যাংশ না দেয়া কোম্পানিটির দর আরও বেড়েছে ১০ শতাংশ। আগের দিন দাম ছিল ৫৫ টাকা। সেখান থেকে ৫ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা ৫০ পয়সা।
গত অক্টোবর ফেব্রুয়ারি থেকে দুর্বল এই কোম্পানিটির শেয়ারদরে অস্বাভাবিক উত্থান দেখা দিয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি শেয়ারদর ছিল ২৪ টাকা, আড়াই গুণ হতে সময় লাগল আড়াই মাস।
গত এক বছরে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ১৯ টাকা ১০ পয়সা।
তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনে আয় বৃদ্ধির খবরে ইউনিক রিসোর্ট অ্যান্ড হোটেলের দাম বেড়েছে ৯.৯৮ শতাংশ। এই কোম্পানিটি দর বৃদ্ধির তালিকায় ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।
আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬৩ টাকা ১০ পয়সায়। দাম বেড়ে আজ হাতবদল হয়েছে ৬৯ টাকা ৪০ পয়সায়।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা জেএমআই হসপিটালের দর বেড়েছে ৯.৯৭ শতাংশ। ২০ টাকায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির দর উঠেছে ৭৮ টাকা ৩০ পয়সায়।
চতুর্থ সর্বোচ্চ সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের দর বেড়েছে ৬.৭0 শতাংশ। আগের দিন প্রতিটি শেয়ার হাতবদল হয়েছিল ১৬ টাকা ৪০ পয়সায়। আজকে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা।
কখনও লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাস না থাকা শ্যামপুর সুগারের দর ৬.৪০ শতাংশ, এপেক্স ফুটওয়্যারের দর ৬.১৭ শতাংশ, বিডি ল্যাম্পসের দর ৫.৯০ শতাংশ, এছাড়া রানার অটোর দর ৫.৪৬ টাকা, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের দর ৫.২২ শতাংশ এবং মনোস্পুল পেপারের দর ৪.৭১ শতাংশ বেড়েছে।
দরপতনের শীর্ষ ১০
শীর্ষ ১০টি কোম্পানিরই দর কমেছে পাঁচ শতাংশ ও এর আশেপাশে।
এর মধ্যে চলতি বছর আগের বছরের তুলনায় আয় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়ার প্রতিবেদন দেয়া ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের দর কমেছে ৪.৯৯ শতাংশ। এক হাজার ৯৩২ টাকা ২০ পয়সা থেকে নেমে দর দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৩৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪.৯১ শতাংশ দর কমেছে আমান ফিডের। ৪২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪০ টাকা ৬০ পয়সায়।
আগের দুই দিন ইন্স্যুরেন্স খাতে দর বাড়তে দেখা যায়। আজ দরপতনের শীর্ষ দশের ছয়টি এ খাতের। কোম্পানিগুলো হলো প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স ও ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।
শীর্ষ দশের অন্য অন্য দুই কোম্পানি হলো এসইএমল লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড ও নাহি অ্যালুমিনিয়ম।
লেনদেনে শীর্ষ পাঁচ খাত
১২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা লেনদেন করে শীর্ষে রয়েছে বিবিধ খাত। যা মোট লেনদেনের ১৫.২০ শতাংশ। আর কোনো খাতের লেনদেন ১০০ কোটি ছাড়ায়নি। খাতটির ১০টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৪টির।
এপরেই ৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বস্ত্র খাতে। সবচেয়ে বেশি ৪২টি কোম্পানির দর বেড়েছে এ খাতের। ১৩টির দর হ্রাস পেয়েছে ও অপরিবর্তিত ছিল ৪টির দর।
তিনটি করে কোম্পানির দর বেড়েছে ও কমেছে কাগজ ও মুদ্রণ খাতে। ৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্য তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল খাতটি। এই খাতের কোম্পানি সোনালী পেপারেই হাতবদল হয়েছে ৬২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতের ১৪টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির দিনে লেনদেন হয়েছে ৭০ কোটি ১০ লাখ টাকা। বিপরীতে দর কমেছে ১৫টি কোম্পানির।
প্রকৌশল খাতের ২৩টি কোম্পানির দর বাড়ার দিনে লেনদেন হয়েছে ৬৯ কোটি ৯০ লাখ। দর কমেছে ১৬টির ও তিনটির অপরিবর্তিত ছিল।
এছাড়া ব্যাংক, খাদ্য, আইটি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে দর বৃদ্ধি দেখা গেছে।