ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস টাকা বিনিয়োগের সুবিধা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ ছেড়েছে, তাতে ৩০ দিন মেয়াদি বিলের হিসাব পাওয়া গেছে। ০.৫৪ শতাংশ সুদে এই বিলে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ব্যাংকগুলো।
গত ১১ আগস্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩০ দিন মেয়াদে যে বিনিয়োগ করেছে, তাতে সুদহার দশমিক ৫৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো মুনাফা করবে ২ কোটি ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
এর আগে ৯ আগস্ট নিয়ে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বিলের নিলাম হয়।
সাত দিন মেয়াদি বিলে ব্যাংকগুলো বার্ষিক শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করে ১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো এই বিলের বিপরীতে সুদ হিসেবে আয় করে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা।
১৪ দিন মেয়াদি বিলে বিনিয়োগ করা হয় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই বিলের সুদহার নির্ধারণ করা হয় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই বিলের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ হিসেবে আয় করবে ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৬ টাকা।
সব মিলিয়ে প্রথম দিনের নিলামে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে ২ হাজার ৬০৫ কোটি। বিপরীতে ব্যাংকগুলো আয় ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬০ টাকা মুনাফা করেছে।
সবমিলিয়ে ৭, ১৪ ও ৩০ দিনের নিলামে ব্যাংকগুলো ৮ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা পাবে ৩ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার ৯৬০ টাকা।
আপাতদৃষ্টিতে এই অর্থ নগণ্য মনে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ না নিলে এই অর্থ ব্যাংকগুলোর কোষাগারে যাওয়ার কথাই ছিল না।
টাকার অভাব নেই বলে ব্যাংকগুলো নতুন আমানত সংগ্রহে অনীহা দেখাচ্ছে। এতে আমানতের সুদহার কমতে কমতে বছরে দেড় থেকে দুই শতাংশেও নেমে এসেছে।
এই অবস্থায় ব্যাংকে টাকা জমা করতে যারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, তাদের টাকা আবার অপব্যয় হচ্ছে বা অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ ছেড়ে অলস টাকা তুলে নেয়ার পাশাপাশি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, তারা অতিরিক্ত টাকা তুলে নিলে ব্যাংকগুলো আবার আমানত সংগ্রহ আগ্রহী হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে বিনিয়োগের জন্য আরও ছয়টি নিলাম হবে। এর মধ্যে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বিলের ওপর চারটি নিলাম হবে ১৬ ও ২৫ আগস্ট।
অন্যদিকে ৩০ দিন মেয়াদি বিলের পরের দুটি নিলাম হবে ২৩ ও ৩১ আগস্ট।
প্রথম তিন নিলামের সমপরিমাণ বিনিয়োগ হলেও নয়টি নিলামে ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর অলস পড়ে থাকা টাকা থেকে তাদের আয় হবে ১০ কোটি টাকার মতো। তবে বিনিয়োগ বাড়লে আয়ও বাড়বে।
বর্তমানে আন্তঃব্যাংক কলমানিতে সর্বনিন্ম সুদ ১ শতাংশ এবং আন্তঃব্যাংক রেপোতে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বার্ষিক সুদহার নির্ধারিত আছে। সর্বনিন্ম এই সুদে টাকা খাটানোর পরও অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে অলস টাকা থাকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো আর এই টাকা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করবে না। ফলে যেটুকু সুদ দিচ্ছে একেবারে ফেলে না রেখে তাতেই ব্যাংকগুলো খুশি।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকের হাতে বিপুল অলস টাকা রয়েছে। এ টাকার বিপরীতে ব্যাংকের কোনো আয় নেই। এজন্য সুদহার কম হলেও এখানে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের কিছু মুনাফা তো হচ্ছে। আর অলস টাকা তুলে নিলে ব্যাংকগুলো আমানতে আগ্রহ দেখাবে। ফলে আমানতকারীরা লাভবান হবেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘১ শতাংশের নিচে সুদহার কম নয়। ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত টাকা অলস পড়ে ছিল। কোনো লাভ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যম ব্যাংকগুলো অন্তত কিছু টাকা বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে।’
অলস টাকা কত
করোনার মধ্যে প্রবাসী আয় অনেকটা বেড়েছে। এই অর্থের একটি বড় অংশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। আবার প্রণোদনার এক লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণের একটি অংশ ঘুরে ফিরে আবার ব্যাংকেই এসেছে।
জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে একবারে অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অলস এ অর্থের বিপরীতে কোনো সুদ পায় না ব্যাংক। এতে করে অধিকাংশ ব্যাংক এখন আমানত নিতে অনীহা দেখাচ্ছে।
এই সাড়ে ৬২ হাজার কোটির মধ্যে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে যাওয়ায় আগামী ৬ নিলামে আরও ৫৪ হাজার কোটি টাকার মতো অলস টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আছে।
কেন বাড়ল অলস টাকা
করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর বাজারে তারল্য বাড়াতে নানা নীতিসহায়তা দিলেও ঋণ চাহিদা বাড়েনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সাড়ে ১৪ শতাংশ ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণা হলেও অর্জিত হয়েছে ৮ শতাংশের মতো। প্রত্যাশিত ঋণ না বাড়ায় বাড়ছে অলস অর্থ।
সাধারণভাবে নগদ জমার হার (সিআরআর) সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোর ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অলস থাকে। তবে করোনা শুরুর পর ২০২০ সালের জুন শেষে তা ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হয়।
সম্প্রতি ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সিআরআরের অতিরিক্ত রিজার্ভ গত এক বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ গত বছরের জুনের তুলনায় প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
বিনিয়োগের সুযোগ আরও আসছে
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ড বিক্রয়ের (রি-ইস্যু) নিলাম হয় ১০ আগস্ট মঙ্গলবার। এটির সঙ্গে অবশ্য এই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই নিলামও ব্যাংকগুলোর অলস টাকা বিনিয়োগের একটি সুযোগ তৈরি করবে।
মঙ্গলবার পাঁচ বছরের বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ড বিক্রির (পুনরায় ইস্যু) নিলামের মাধ্যমেও এক হাজার কোটি টাকা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫ বছরের ট্রেজারি বিলের সুদ হার ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ।
নিলামে গত ১৮ মার্চ ইস্যুকৃত পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২০২৬ সালের ১৮ মার্চ, এক কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের বন্ড রি-ইস্যু করা হয়। এখানে ব্যাংকগুলো মোট ২ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা ইস্যু করে।
আসছে ১০ বছর-মেয়াদি গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ডের নিলাম
বাংলাদেশ ব্যাংকে ১০ বছর-মেয়াদি বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ড বিক্রয়ের (রি-ইস্যু) নিলাম হবে ১৭ আগস্ট মঙ্গলবার।
নিলামে চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত ১০ বছর-মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড (কুপন হার ৬.০১ শতাংশ), এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০৩১ এর এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের বন্ড রি-ইস্যু করা হবে।
রি-ইস্যু নিলাম প্রাইজভিত্তিক হবে। নিলামে রি-ইস্যুকৃত ট্রেজারি বন্ড ডিসকাউন্টে, প্রিমিয়ামে বা অভিহিত মূল্যে বিক্রয় হতে পারে।
বিজয়ী বিডাররা স্ব স্ব বিডমূল্য পরিশোধ করবে। রি-ইস্যুকৃত বন্ডের জন্য বার্ষিক ৬.০১ শতাংশ হারে কুপন বা মুনাফা ষান্মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ্য হবে।
নিলামে কেবল সরকারি সিকিউরিটিজের প্রাইমারি ডিলারের ভূমিকায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিড দাখিল করতে পারবে। তবে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও (নিজস্ব খাতে বা তাদের ব্যক্তি/প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গ্রাহকদের জন্য) প্রাইমারি ডিলারের মাধ্যমে অকশনে বিড দাখিল করতে পারবে।
অভিহিত মূল্যে প্রতি ১০০ টাকা মূল্যের বন্ড ক্রয়ের জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রাইস ও বন্ড ক্রয়ের পরিমাণ উল্লেখ করে নিলামের দিন সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত এমআই মডিউলের মাধ্যমে বিড দাখিল করতে হবে।
তবে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে পূর্বে অনুসৃত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিড দাখিল করা যেতে পারে।
নিলামে অংশগ্রহণের পদ্ধতিগত নির্দেশনা ইতোমধ্যে প্রাইমারি ডিলারসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে।