বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রড-সিমেন্টের লাগামহীন দামে থমকে যাচ্ছে উন্নয়ন

  •    
  • ১৪ আগস্ট, ২০২১ ১১:১৫

ঠিকাদাররা বলছেন, নির্মাণ উপকরণের দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় সরকারি উন্নয়নকাজে আগের চুক্তিতে তাদের পোষাচ্ছে না। এ কারণে কাজের গতি যাচ্ছে কমে। আবার বেসরকারি নির্মাণকাজও মুখ থুবড়ে পড়ছে। নির্মাণ উপকরণের কোনো কোনোটির দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।

সারা দেশে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণ কাজ। এই মুহূর্তে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো ছাড়া কোনো প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়নে নেই গতি।

প্রায় বছর ধরে নির্মাণসামগ্রীর মুখ্য উপকরণ রড, সিমেন্ট ও ইট-পাথরের দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

দাম স্থিতিশীল রাখতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ইস্পাত এবং সিমেন্ট শিল্পে আগাম কর প্রত্যাহার করে নেয়। পাশাপাশি লৌহজাত পণ্য প্রস্তুতে ব্যবহার্য কয়েকটি কাঁচামাল, স্ক্র্যাপ ভেসেল ও পিভিসি, পিইটি রেজিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইথানল গ্লাইকলসহ বিভিন্ন পণ্যের আগাম কর অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু বাজেট কার্যকরের পর এক মাস পার হলেও বাজারে কমেনি এসব নির্মাণ উপকরণের দাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের হাতে এখন ছোট-বড় ও মাঝারি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২ হাজার প্রকল্পের উন্নয়নকাজ চলমান আছে। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার কাজও চলছে। এ ছাড়া আবাসন চাহিদা পূরণেও খাতসংশ্লিষ্টদের হাতে রয়েছে সহস্রাধিক প্রকল্প। উৎপাদনমুখী বিভিন্ন খাতেও শিল্প-কারখানা নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। এর বাইরে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত কয়েক লাখ ঘর-বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে।

এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান উন্নয়নযজ্ঞে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টন রড, সিমেন্ট, ইট ও পাথরের জোগান প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু দেশে-বিদেশে করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং দফায় দফায় লকডাউনে এসব উপকরণের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যা সার্বিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় থাকা পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ হাতেগোনা কয়েকটি প্রকল্প ছাড়া অন্য সব প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখায় ভাটা পড়েছে।

উপকরণের মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে বাড়তি খরচ সমন্বয়ের সুযোগ না থাকায় বেঁকে বসছে অধিকাংশ ঠিকাদার। জরুরি বিবেচনায় আগের চুক্তিমূল্যেই যারা কাজ চালিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের কাজের গতিও খুব ধীর এবং সেখানে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অন্যদিকে দাম কমার আশায় ব্যক্তি উদ্যোগে ঘর-বাড়ি নির্মাণকাজ এবং উদ্যোক্তাদের চলমান অনেক উন্নয়নকাজও এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (রিহ্যাব) জানিয়েছে, শুধু চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই দেশে অবকাঠামো নির্মাণে খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ২০ শতাংশ।

অন্যদিকে দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি (বিএসিআই) জানায়, প্রকৌশল বিধি অনুযায়ী প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝে ৩৮ থেকে ৪২ শতাংশ রড, ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ ইট বা পাথর এবং ১৮-২২ শতাংশ পর্যন্ত সিমেন্ট ব্যবহারের দরকার পড়ে। অর্থাৎ কোনো একটি অবকাঠামোর কমপক্ষে ৯০ শতাংশজুড়েই থাকে এসব উপকরণ। এর কোনো একটির ঘাটতি হলে অবকাঠামোর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

গত বছর ডিসেম্বর থেকে এই সময় পর্যন্ত উপকরণভেদে রডের দাম ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ, পাথরের ৩৫ শতাংশ, সিমেন্টের ১৫ শতাংশ এবং ইটের ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাজার পরিস্থিতি

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের রডের দাম প্রতি টনে বেড়েছে ১৮-২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে ভালো মানের ৭৫ গ্রেডের এমএস (মাইল্ড স্টিল) রড এখন কোম্পানিভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৭৪ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছর নভেম্বরে এই গ্রেডের রড বিক্রি হতো ৫২-৫৪ হাজার টাকার মধ্যে।

৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৬৬-৬৭ হাজার টাকায়। গত বছর নভেম্বরে এই দাম ছিল ৪২-৪৪ হাজার টাকার মধ্যে। সাধারণ ৪০ গ্রেডের প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬৩ হাজার ৫০০ থেকে ৬৪ হাজার টাকায়। একই রড গত নভেম্বরে ছিল ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া বাংলা রড (গ্রেড ছাড়া) বিক্রি হচ্ছে ৬১ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছর নভেম্বরে এর দাম ছিল মাত্র ৩৮ হাজার টাকার মধ্যে।

বাজারে এখন সিমেন্টের সর্বনিম্ন দাম বস্তাপ্রতি ৪১০ টাকা থেকে ৪৮০ টাকার মধ্যে। এই সময়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বস্তাপ্রতি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৩০-৫০ টাকা।

প্রতি টন পাথরের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে ৪০০-৬০০ টাকা এবং ইটের দর প্রতি হাজারে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।

চাহিদা বনাম সরবরাহ

দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০০টি ইস্পাত কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ টন। আর অভ্যন্তরীণ ইস্পাত ব্যবহারের পরিমাণ ৭৫ লাখ টন।

সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা ৩৮টি। উৎপাদনে আছে ৩৪টি। সব কোম্পানির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪ কোটি টন। কিন্তু কারখানাগুলোর সক্ষমতার তুলনায় বাজারে চাহিদা কম। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী ২ কোটি ৪০ লাখ টন থেকে সোয়া ৩ কোটি টন উৎপাদনে সীমাবদ্ধ থাকছে কোম্পানিগুলো।

খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) তথ্য বলছে, উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডের কারণে এখন প্রতি বছর পাথরের চাহিদা তৈরি হচ্ছে ৭০-৮০ লাখ টন। এর ৮৩ দশমিক ৪ ভাগই আমদানিনির্ভর। মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পূরণ হয় দেশীয় উৎপাদন থেকে। অর্থাৎ গড়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন পাথর আমদানি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি পিস ইটের চাহিদা তৈরি হয়। সারা দেশে ছোট-বড় আধুনিক ও সনাতনী সাড়ে ৬ হাজার ইটভাটা থেকে তার চেয়ে বেশিই ইট উৎপাদন করছে, যার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ইট সরকারি প্রকল্পে ব্যবহার হয়।

দাম নিয়ে সংকটের নেপথ্যে

লাগামহীন দাম বৃদ্ধির পেছনে এসব উপকরণের স্থানীয় উৎপাদক ও বাজারজাতকারীরা দায়ী করছেন আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি এবং জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধিকে।

খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, চাহিদার বিপরীতে প্রায় সব উপকরণেরই সরবরাহ আছে দেশে। তবে দেশে এসব উপকরণ উৎপাদনের বেলায় সারা বছর নির্ভর করতে হয় কাঁচামাল আমদানির ওপর।

বাংলাদেশে স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) চেয়ারম্যান শেখ মাসুদুল আলম মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, স্টিল ও রডের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ‘বিলেট ও স্ক্র্যাপ’-এর প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। কিন্তু করোনার গ্যাঁড়াকলে আন্তর্জাতিক বাজারে এ কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।

তিনি জানান, গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রতি টন স্ক্র্যাপের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ছিল ২৭০-৩৫০ ডলারের মধ্যে। এখন তা ৫৬০-৫৭০ ডলারে ওঠে গেছে। বিলেটের বাজারমূল্য ছিল ৭৫০-৮০০ ডলারের মধ্যে। এখন সেটি ১ হাজার ৩৫০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

আগে দেশে এক কনটেইনার মেল্টিং মেটাল আমদানিতে খরচ পড়ত ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। এখন একই পরিমাণ মেল্টিং মেটাল আমদানিতে খরচ পড়ে ২ হাজার ৮০০ ডলার পর্যন্ত। দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

একইভাবে বেড়েছে কেমিক্যালের দামও। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশেও এর দাম সমন্বয় করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, দেশে সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকারের ৭৫ ভাগ আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে এই ক্লিংকারের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেশে জাহাজীকরণের খরচও বেড়ে গেছে।

জানা গেছে, আগে ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনাম এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রতি টন ক্লিংকার পরিবহনে ২২ থেকে ২৪ ডলার খরচ হতো। এখন তা গুনতে হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ ডলার পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রতি টন ক্লিংকারের সিএফআর মূল্য পড়ছে ৬০ থেকে ৬৫ ডলার, যা গত বছর নভেম্বরে ছিল ৫৫-৫৭ ডলার।

বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বাবুল জানান, ইট পোড়ানোর প্রধান কাঁচামাল হলো কয়লা। এর ৬৫-৭০ ভাগই আমদানি হচ্ছে। রপ্তানিকারক দেশগুলোতে দাম বেশি। আনতে ভাড়াও লাগছে বেশি। শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। এর প্রভাব ইটের দামে পড়েছে।

জানা গেছে, প্রতি টন কয়লার দাম বেড়ে এখন ১৪ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে এর দাম ছিল ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে।

একই তথ্য দিয়েছেন পাথর আমদানিকারকরাও। দেশে প্রয়োজনীয় পাথরের ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করতে হচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পাথরের চাহিদা বেড়েছে। রপ্তানিকারক দেশগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে টনপ্রতি পাথরের দাম।

পাথরের আমদানি মূল্য টনপ্রতি ৬ ডলারের বেশি নয়। কিন্তু দাম বাড়াচ্ছে পরিবহন ও মজুরি খরচ। ৪ থেকে ৬ ডলারের মধ্যে এলসি করা পাথর ওই দেশের কোয়ারি থেকে জাহাজে উঠানো ও চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছতে মোট আমদানি মূল্য দাঁড়ায় টনপ্রতি ১৯ থেকে ২২ ডলার পর্যন্ত। অর্থাৎ পাথরের এলসি মূল্যের চেয়ে পরিবহন ও ‌উঠানো-নামানোর খরচ বেশি।

সবচেয়ে নিকটবর্তী রপ্তানিকারক দেশ ভারতে প্রতি টন পাথরের দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

সরবরাহ চেইনেও আছে জটিলতা

চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দফায় দফায় লকডাউনে পড়েছে দেশ। একই পরিস্থিতি ছিল উপকরণের রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও। ফলে সর্বত্র বিঘ্নিত হয়েছে উৎপাদন। এ কারণে কমেছে রপ্তানি।

অন্যদিকে বিশ্বের বৃহৎ উৎপাদনকারী দেশ চীন আগে মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানি করত খুব কম। নিজস্ব খনিজ লোহা দিয়েই তারা স্টিল উৎপাদনে ছিল। এখন বিভিন্ন কারণে চীন মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী স্ক্র্যাপ মেটালের একটা বড় অংশ এখন সেখানেই যাচ্ছে।

সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার এবং পাথর ও কয়লার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। এতে আমদানিও দীর্ঘসূত্রতায় পড়ছে। দেশেও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইনেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া দফায় দফায় লকডাউন শুরু হওয়ায় উপকরণের বাজারমূল্য আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।

আবাসন খাতে কী ক্ষতি

রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১৫১। গড়ে একটি করে ধরলেও সমপরিমাণ প্রকল্পের চাহিদা আছে। কিন্তু বাড়তি খরচের ভয়ে এখন নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার সাহস করছে না কেউ। সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে। অথচ সবার এখন নতুন প্রকল্প শুরু জরুরি হয়ে পড়েছে।’

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০২০ সালের শুরুর দিকে আবাসন ব্যবসায়ীদের হাতে প্রায় ৬ হাজার রেডি ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রিত ছিল। গত এক বছরে তার থেকে ৫ হাজার ৫১৮টি বিক্রি হয়ে গেছে। অর্থাৎ আবাসন খাতে রেডি ফ্ল্যাট স্মরণকালের সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে।

নানা বাস্তবতার কারণে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহ বহুগুণ বেড়েছে। তারা সক্ষমতা অনুযায়ী ছোট ফ্ল্যাট সুলভমূল্যে পেতে চায়। ফলে এখনই কয়েক হাজার ফ্ল্যাটের নির্মাণকাজ শুরু করা জরুরি। তার ওপর দেড় হাজারের বেশি ফ্ল্যাটের বুকিং অর্ডার রয়েছে। কিন্তু নির্মাণ উপকরণের মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে এখন কোনো প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। একইভাবে বড় পরিসরের ফ্ল্যাট নির্মাণও শুরু করা যাচ্ছে না।

রিহ্যাব সভাপতি বলেন, উপকরণসামগ্রীর দামে এখনই লাগাম পরানো না গেলে অধরাই থেকে যাবে মধ্যবিত্তের নিজস্ব আবাসনের স্বপ্ন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আবাসন খাতে।

সরকারি প্রকল্পে ধীর গতি, ক্ষতিতে ঠিকাদাররা

আবাসন ব্যবসায়ীদের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি এখন সরকারি উন্নয়নকাজের ঠিকাদারদের।

এ প্রসঙ্গে বিএসিআইর প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার এস এম খোরশেদ আলম নিউজবাংলাকে জানান, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো ফিক্সড প্রাইস চুক্তিতে চলে। কাজ সম্পাদনের নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেয়া থাকে। কিন্তু দেশে নির্মাণ উপকরণের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ায় প্রায় বছর ধরে কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলছে না।

তিনি জানান, সরকারি কোনো প্রকল্পেরই চলমান কাজ এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। জরুরি বিবেচনায় কয়েকটির কাজ চালিয়ে নেয়া হলেও উপকরণের বাড়তি দামে প্রকল্পের ব্যয় আগের সীমায় আটকে রাখা যাচ্ছে না। এতে লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন ঠিকাদাররা। উপকরণের দাম বৃদ্ধির হার অনুযায়ী কাজ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাড়তি খরচ আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে আগের নির্ধারিত চুক্তিমূল্য থেকে ২০ শতাংশ বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদাররা সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে না পারছেন প্রকল্প গুটিয়ে চলে যেতে, আবার না পারছেন লোকসান দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন দীর্ঘসূত্রতায় গড়াচ্ছে। আবার উন্নয়নকাজের মান নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও প্রকট হবে, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর।

বিএসিআইর সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এস এম খোরশেদ আলম দাবি করেন, সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সুফল পৌঁছায়। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এর বাস্তবায়ন হওয়ার পাশাপাশি এগুলোর মানসম্পন্ন বাস্তবায়নও দরকার। এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ফিক্সড প্রাইস কনট্রাক্টের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি তা বহালও থাকে, তাতে সময়ে সময়ে পরিপত্র জারির মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উপকরণগুলোর দাম সমন্বয় করে ভ্যারিয়েশন বিল দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। একইভাবে পিপিআরের বিধান অনুযায়ী ভবিষ্যতে আহ্বানকৃত সব দরপত্রের প্রাইস সমন্বয়ের ধারা অন্তর্ভুক্ত করা না হলে প্রকল্পের বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা কমানো যাবে না।

উপকরণের বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়মিত মনিটরিং হয়। বিভিন্ন সময় বাজারভেদে পরিচালনা করা হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য না হলেও নিয়মিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিদিন ব্যবহার হয় হাজার হাজার টন রড, সিমেন্ট, পাথর ও ইট; যার দামের ঊর্ধ্বগতি দেখার নেই কেউ।

এ পরিস্থিতিতে এসব উপকরণের প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি ও বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ রেখেছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, উচ্চ মুনাফানির্ভর এসব খাতের সরবরাহকৃত উপকরণে ভোক্তারা ঠকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটা যাতে না হয়, সে জন্য ভোগ্যপণ্যের মতো ফিনিশড পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণেও বাজার মনিটরিং সুফল দিতে পারে। এর পাশাপাশি সরকার বাজেটে যে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে, তা কতটা কার্যকর হয়েছে, সেটি না হলে গলদ কোথায় কিংবা গৃহীত উদ্যোগ যথেষ্ট কিনা, না হলে আরও কী করা যেতে পারে, সমষ্টিগত উন্নয়ন স্বার্থে তা বিবেচনায় নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

কী ভাবছে সরকার

বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের প্রধান আমদানি কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফীকুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, ‘এটা ঠিক, দেশে নির্মাণসামগ্রীর দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ ধরনের উপকরণের দাম বেড়ে গেলে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন খরচই বাড়ে। এতে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতার বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে দাম বাড়লে দেশেও বাড়ে।

এক প্রশ্নের জবাবে দেশের প্রধান এই আমদানি কর্মকর্তা জানান, ‘উত্তরণের উপায়টি কারও একার হাতে নেই। এটি সম্মিলিত উদ্যোগের বিষয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দুই ভাবে কাজ করছে। বিশ্ববাজার থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, তা দেশে আনার খরচ অত্যধিক বেড়েছে। এর যৌক্তিকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার উপায়ও বের করার চেষ্টা চলছে।

‘এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে উপকরণের কাঁচামালের দাম বেড়েছে, তা দেশে কারখানায় ফিনিশড পণ্যের উৎপাদন শেষে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তা কতটা যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক সেটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ মাধ্যমে ট্যারিফ কমিশনকে প্রতিবেদন দেয়ার অনুরোধ করা। এর মধ্যে বাজার পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে না এলে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর