করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম বছর ব্যাংকগুলো চাপে থাকলেও বছর শেষে পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন যতটা অবাক করেছে, দ্বিতীয় বছরে অর্ধবার্ষিকে গত বছরের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণ, এমনকি তিন ও চার গুণ আয় সৃষ্টি করেছে বিস্ময়।
দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন সীমিত, প্রণোদনার ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের পরও যখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক, তখন কীভাবে এত বেশি মুনাফা হয়, তা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে যে ছাড় দিয়েছে, কিস্তি না দিলেও খেলাপির তালিকায় না ফেলা, সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় দেয়ার যে ব্যবস্থা করেছে, সেটিই এর কারণ কি না, তা নিয়ে আলোচনা আছে। ঢালাও একটি বিশ্বাস ছড়িয়েছে যে, ঋণের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং করতে হয়, সেটি না করাই এর কারণ কি না।
বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এটি শতকরা ১ শতাংশ থেকে শুরু করে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় দিয়েছে।
তবে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিট তা বলছে না। ঋণের বিপরীতে কোনো কোনো ব্যাংক সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছে তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
তাহলে কেন এই মুনাফা
ব্যাংকাররা বলছেন বেশ কয়েকটি বিষয়। আমানতের সুদহার কমতে কমতে এখন দেড় শতাংশের কাছাকাছি নামিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক। আগের নেয়া বেশি সুদহারের আমানত মিলিয়েও এখন গড় সুদহার ৪ শতাংশের নিচে নেমেছে। আর সুদহার এখন ৯ শতাংশের কম হলেও আমানতের সুদের যে খরচ হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ পাওয়া যায় ঋণের সুদহার থেকে।
আবার করোনাকালে ব্যাংকগুলোর শাখা বিধিনিষেধের কারণে খোলা রাখতে হচ্ছে সীমিত সময়ের জন্য। বন্ধও রাখা হচ্ছে কখনো কখনো। এতে কমেছে পরিচালন খরচ। বিশেষভাবে যাতায়াত খরচ কমেছে অনেক বেশি।
বিভিন্ন ব্যাংকের মুনাফার চিত্র
আবার পুঁজিবাজারে ব্যাংকের যে বিনিয়োগ ছিল, সেখান থেকে ব্যাপক মুনাফা এসেছে। পুঁজিবাজারে মন্দাভাবের সময় তারা বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু বিশেষ করে গত বছর ব্যাপক লোকসান হয়েছে। সেগুলোর বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, সেটি এখন করতে হচ্ছে না।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংক মুনাফায় রয়েছে। ২৯টি ব্যাংক জুন শেষে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে লোকসানে থাকা একটির আয় বাড়েওনি, কমেওনি। তিনটির আয় কমেছে, বেড়েছে বাকি ২৫টির মুনাফা।
গত বছরের তুলনায় আয় তিন গুণের বেশি বাড়াতে পেরেছে দুটি ব্যাংক। দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে পেরেছে চারটি ব্যাংক।
দেড় গুণের বেশি বাড়াতে পেরেছে পাঁচটি ব্যাংক। এক-তৃতীয়াংশের বেশি বাড়াতে পেরেছে দুটি ব্যাংক। আর ২৫ শতাংশের বেশি বাড়াতে পেরেছে তিনটি ব্যাংক।
২০ শতাংশের বেশি ও ২৫ শতাংশের কম বেড়েছে আরও তিনটি ব্যাংকের। বাকিগুলোর আয় বাড়ার হিসাব খুব একটা বেশি নয়।
ব্যাংকাররা কী বলছেন
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আগের বছরের তুলনায় খরচ অনেক কমিয়েছে। বেতন খরচ ছাড়া অন্যান্য অপারেটিং খরচ কমিয়ে আনা হয়েছে। এটার প্রভাব পড়েছে অনিরীক্ষিত মুনাফার হিসাবে। ব্যালান্স শিট ভালো ম্যানেজ করেছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল খরচ কমানো, সেটা আমরা পেরেছি।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আরফান আলী বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে ইন্টারেস্ট রেট লো। করোনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলো বাড়তি প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) করেনি। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দেয়া করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে নতুন তেমন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো আগের নিয়মে প্রভিশনিং করছে। এ কারণে মুনাফা বাড়তি দেখাতে পেরেছে।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ নেই, ঋণ বিতরণ কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে জুন পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রভিশনিংয়ে ব্যাংকগুলো কিছুটা ছাড় পেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আয়ে। আর নতুন ঋণ বিতরণ তেমন নেই বললেই চলে। এ জন্য সঞ্চিতি সংরক্ষণেও তেমন সমস্যা হচ্ছে না।’
আহসান এইচ মনসুর এটাও বলেন, ‘আমরা (ব্র্যাক ব্যাংক) ৩৫০ কোটি টাকা সঞ্চিতি রেখেই ছয় মাসের হিসাব দেখিয়েছি।’
বিভিন্ন ব্যাংকের মুনাফা
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘সিটি ব্যাংকের ২০২০ সালের পরিচালন মুনাফা থেকে আমরা অতিরিক্ত ১৭০ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) করেছি। চলতি বছরও পরিচালন মুনাফা থেকে ২০০ কোটি টাকা বাড়তি সঞ্চিতি রাখতে চাই।’
অর্ধবার্ষিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিচালন মুনাফা করা পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী বলেন, ‘ঋণ বিতরণ কমলেও বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেখান থেকে ব্যাংকের আয় বেড়েছে।
‘পাশাপাশি যারা আগে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছিল, তারা ভালো মুনাফা পাচ্ছে। ওই মুনাফায় কর নেই, তা থেকে আলাদা সঞ্চিতিও রাখতে হয় না। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকেও আয় বেড়েছে। এ ছাড়া ঋণ নতুন করে খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকের খরচ কমেছে।’
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে আমাদের ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে যাদের মুনাফা বেড়েছে, তাদেরও একই ধরনের ব্যবসা বেড়েছে।’
একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় দেখিয়ে, আমানতের সুদের বিপরীতে সংরক্ষিত সঞ্চিতি ও ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য সুদকে আয় হিসেবে দেখিয়ে মুনাফা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল কারণ হলো আমানতে সুদহার অনেক কম। ঋণ বিতরণ একদম হচ্ছে না, সেটা নয়। যেসব ঋণ নিয়মিত রয়েছে, ওই সব ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া হচ্ছে। এ কারণেই বেড়েছে ব্যাংকের মুনাফা।’
ব্যাংকের হিসাবে বিভিন্ন টার্ম রয়েছে। মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ ‘পেয়েবল’ হিসেবে সঞ্চিতি রাখতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পেয়েবল হিসেবে রাখা টাকাকে আয় খাতে প্রদর্শন করছে।
এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভেবল’ হিসেবে টাকা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভেবল আয় হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কেই আয় প্রকৃতপক্ষে না হলেও তা আয় হিসেবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বাড়ছে মুনাফা।
নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ ১১ ব্যাংক, পুঁজিবাজারের ৬টি
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬২ হাজার ৮০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
১১ ব্যাংকের তালিকায় চারটি সরকারি, বেসরকারি ছয়টি ও বিশেষায়িত একটি ব্যাংক রয়েছে।
বছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রয়োজনীয় সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রূপালী ব্যাংক।
বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এর মধ্যে কমার্স ছাড়া বাকিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকও এই কাতারে রয়েছে।
জানুয়ারি-মার্চ শেষে ১১ ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১২ হাজার ৬৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
বাকি ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দিয়েছে। এ কারণে ওই ব্যাংকগুলোর বিপুল ঘাটতি অনেকটাই কম দেখাচ্ছে।
গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিকভাবে সব ব্যাংকের মোট ৬৩ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা সঞ্চিতি রাখার কথা ছিল। তবে ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করে ৬৩ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। তখন ঘাটতি ছিল ১২৫ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার ২৫৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৬৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৩৫৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ৭৮৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
মার্চ শেষে কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৫৫৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ঢাকা ব্যাংকের ২৪৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৯৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩৩৮ কোটি ১২ লাখ টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৭৩ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১৫৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১৬৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।