শিল্প কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে বড় ধরনের সংস্কার অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের কারখানা আগুনে পোড়ার পর শিল্প কারখানা নিরাপদ করতে ২৪ সদস্যের বহুপক্ষীয় যে কমিটি করা হয়েছে, তার দায়িত্ব পাওয়ার পর শুক্রবার এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে আসেন তিনি।
সালমান বলেন, ‘কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হবে। সে আলোকে সংস্কার কাজ শুরু হবে।’
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনার পর নানা সময় কমিটি করা হয়েছে। তবে একসঙ্গে সব পক্ষকে নিয়ে কমিটি এই প্রথম। এতে শিল্প কারখানা নিয়ে যতগুলো মন্ত্রণালয় কাজ করে, তারা ছাড়াও থাকছে ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও।
সালমান বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রিপোর্ট দেয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে সিরিয়াস সমস্যা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি এ কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। অতি দ্রুত আমরা কারখানা পরিদর্শন শেষে সংস্কারের রেকমেন্ডেশনগুলো তৈরি করব। দেশের কারখানাগুলোর শ্রম পরিস্থিতি, আইনগত বিষয়সহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে নতুন কমিটি দ্রুত প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী উদ্যোগ নেয়া হবে।’
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি মোটেও বিরল নয়। এ নিয়ে নানা সময় নানা পরামর্শ উঠে এলেও এমনকি সরকার আইন করলেও তার বাস্তবায়ন কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৫২ শ্রমিক। ছবি: নিউজবাংলা
সালমান বলেন, ‘অতীতের সমস্যাগুলো পর্যালোচনা করেই তারা সামনের দিকে অগ্রসর হবো। বর্তমান ব্যবস্থায় কী কী শর্টফল আছে আমরা এগুলো আগে অ্যাড্রেস করব। নতুন করে কাজ করতে হলে অতীতের ভুল ত্রুটি অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে।আরও পড়ুন: বুয়েট আমাদের সাংঘাতিকভাবে ভুল পথে হাঁটিয়েছে: সালমান
‘অনেকগুলোর সরকারি এজেন্সি জড়িত থাকায় পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ থাকে। তাই এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের পরামর্শের আলোকে প্রয়োজনে সব এজেন্সিকে একত্র করে নিরাপত্তা বিষয়ক একটা সিঙ্গেল এজেন্সি করা যায় কি না সেটাও ভাবা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব ফেলেছে। বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে। এজন্য কারখানার ফায়ার, স্ট্রাকচার ও এনভায়রনমেন্ট আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়।
‘এর বাইরে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোও আমরা দেখব। যখন একটি নতুন সংস্থা গড়ে উঠবে তখন ওই সংস্থা যেকোনো দুর্ঘটনার জবাবদিহি করবে। এজন্য যদি বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হয়, প্রয়োজনে তাও করা হবে।’
বর্তমানে কারখানার শ্রম নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্সের মতো বিষয়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব রয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফি)।
বিদ্যমান সংস্থাটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা বলেন, ‘ডাইফির সমস্যাগুলো পরীক্ষা করা হবে। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে নতুন আইন নিয়ে আসা হবে। সে ধরনের পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।’
এর আগে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কল-কারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনারোধ এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে সালমান ফজলুর রহমানকে সভাপতি করে ২৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার।
কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে অগ্নি-দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নেতৃত্বে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে অবিলম্বে সকল শিল্প-কারখানা সরজমিনে পরিদর্শনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এসকল পরিদর্শনের আলোকে শিল্প-কারখানাসমূহের অবকাঠামোগত, অগ্নি ও অন্যান্য দুর্ঘটনা নিরোধের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং করণীয় নির্ধারণে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করবে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামী ১৯ জুলাই সরকারি বেসরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। সেখানে কর্মপন্থা ঠিক করা হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এগিয়ে যাব। প্রয়োজনে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হবে।’
শ্রম সচিব কেএম আব্দুস সালাম বলেন, ‘পোশাক শিল্পের দিকে নজর দিতে গিয়ে অন্য খাতের কারখানার দিকে নজর দেওয়া যায়নি। নারায়ণগঞ্জের এই দুর্ঘটনা নিরাপত্তা বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে, সবাইকে নাড়া দিয়েছে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস ফ্যাক্টরির মর্মান্তিক ঘটনা দেশীয় ভাবমূর্তির বিশাল ক্ষতি করেছে। আমাদের ব্যবসা যেভাবে বেড়েছে, অর্থনীতি যেভাবে বড় হয়েছে, সেই তুলনায় সরকারি তদারক সংস্থার সক্ষমতা বাড়েনি। এখন এই দিকে নজর দিতে হবে। বেসরকারি আরও পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রজ্ঞাপনে কল-কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে গঠিত কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, কল-কারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনারোধ এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষও কমিটি কর্তৃক সরজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে বহুপক্ষীয় এ কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকার সংসদ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন), গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, এফবিসিসিআই’র সভাপতি এবং বিজিএমইএ’র সভাপতিকে এই কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটিতে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিকে সদস্য হিসাবে কো-অপ্ট করা যাবে।