বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বলতেই সবার আগে চলে আসে তৈরি পোশাক শিল্প। কখনো কখনো পাট, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া রপ্তানি নিয়েও আলোচনা হয়। সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে দেন-দরবারও করেন এসব খাতের উদ্যোক্তারা।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির মহাসংকটের সময় ১০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা এনেছে যে খাত, সেটি থেকে গেছে অগোচরে। সেই খাতটি হচ্ছে হোম টেক্সটাইল। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে খাতটি।
করোনাকালে চীন ও ভারতের বাজার বাংলাদেশে চলে আসায় এই ‘নীরব বিপ্লব’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ।
পোশাক খাতের মতো সরকারের সুনজর পেলে এই খাত থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা ঘেঁটে দেখা যায়, হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করে এই অর্থবছরে ১১৩ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার (১.১৩ বিলিলয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। এর আগে কখনোই এ খাতের রপ্তানিতে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি।
বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ি অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার রপ্তানি আয় করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য। বরাবরের মতোই ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে প্রথম স্থানে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত।
এতদিন পাট, চামড়া ও হিমায়িত মাছ রপ্তানি দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকত। এবার হোম টেক্সটাইল পাট খাতের প্রায় সমান ডলার দেশে এনে তৃতীয় স্থান দখল করেছে।
করোনায় কম-বেশি প্রায় সব খাতের অবস্থা নাজুক। রপ্তানি ছাড়াও স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হোম টেক্সটাইল। অনেকটা অগোচরে থেকে দেখাচ্ছে আশার আলো।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বছরে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি আয়ের আরেকটি খাত যোগ হলো।
দীর্ঘদিন শীর্ষ ১০ রপ্তানি খাতের তালিকায় আছে এ খাত। বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বাণিজ্য প্রায় নাস্তানাবুদ। এমন পরিস্থিতিতেও হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
রপ্তানি তালিকার সব পণ্যের মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি দেশের চাহিদার প্রায় পুরোটা জোগান দিচ্ছে এ খাত।
উদ্যোক্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতভাগ স্থানীয়ভাবে জোগান দেওয়া সম্ভব। তারা সরকারের নীতি-সমর্থনের অভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ট্রেন্ড বা ফ্যাশনপ্রবাহ না বোঝা কিংবা কম বোঝাকে দায়ী করছেন।
এসব সমস্যার সমাধানে সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের আরও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বাজার গবেষণা বাড়ানোর কথাও বলেছেন তারা।
দেশে হোম টেক্সটাইল উৎপাদন করে এ রকম উল্লেখযোগ্য বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস, নোমান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস, সাদ গ্রুপ, অলটেক্স, এসিএস টেক্সটাইল, জে কে গ্রুপ, ক্লাসিক্যাল হোম, ইউনিলাইন ইত্যাদি।
হোম টেক্সটাইল আসলে কী
হোম টেক্সটাইল বলতে বোঝায় ঘরের অন্দরের শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা বস্ত্রপণ্য। এ কারণে এ ধরনের পণ্যকে হোমটেক্স বা ঘরোয়া টেক্সটাইলও বলা হয়ে থাকে।
বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টেবিল ক্লথ, পর্দা, ফ্লোর ম্যাট, কার্পেট, জিকজাক গালিচা, ফার্নিচারে ব্যবহার করা ফ্যাব্রিকস, তোশক, পাপস, খাবার টেবিলের রানার, কৃত্রিম ফুল, নকশিকাঁথা, খেলনা, কম্বলের বিকল্প কমফোর্টার, বাথরুম টাওয়েল, রান্নাঘর ও গৃহসজ্জায় ব্যবহার হয় এমন সব ধরনের পণ্য এ খাতের আওতাভুক্ত।
এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা, পাট, শন, রেশম, ভেড়া-ছাগলের পশম, অন্যান্য পশম। এ ছাড়া সম্প্রতি কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারেরও হোম টেক্সটাইল উৎপাদন হচ্ছে দেশে।
চীন ও ভারতের বাজার যেভাবে দখল করছে বাংলাদেশ
তৈরি পোশাকের মতো হোম টেক্সটাইলেরও প্রধান গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এই দুই বাজারে এতদিন একচেটিয়া ব্যবসা করত ইসরায়েল, চীন ও ভারত।
ইসরায়েল মূলত খুব দামি পণ্য রপ্তানি করে। চীন ও ভারত দামি-মাঝারি দুই ধরনের পণ্যই রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশ করে মাঝারি ও কম দামি পণ্য রপ্তানি।
অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চীন ও ভারতের কম ও মাঝারি দামি পণ্যের বাজারের কিছু অংশই আসলে আমাদের এখানে এসেছে। সে কারণে হঠাৎ করে রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
‘ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ওই সব দেশে বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টেবিল ক্লথ, পর্দাসহ অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। তারা তো এসব পণ্য একবারের বেশি ব্যবহার করে না। সে কারণেই একটু ভালো হয়েছে আমাদের জন্য।
‘করোনার পর চীন আর এখন মাঝারি দামের পণ্য তৈরি করছে না। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে ভারতেও উৎপাদন বন্ধ ছিল। সেই বাজারটাই আমরা এখন পাচ্ছি।’
বাংলাদেশের পণ্য ও অন্য দেশের পণ্যের দামের পার্থক্য কেমন জানতে চাইলে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘ধরেন, ইসরায়েল একটি ৪০০ ডলারের বিছানার চাদর রপ্তানি করে; চীন-ভারত করে ১০০-১২৫ ডলারের। আর আমরা করি ২৫-৩০ ডলারের।’
তিনি বলেন, হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয় বছরজুড়ে। এ ছাড়া করোনাকালে গৃহবন্দি মানুষ হোম টেক্সটাইলের পণ্য তুলনামূলক বেশি ব্যবহার করেছেন। এতে চাহিদা বেড়েছে।
বাড়ছে অভ্যন্তরীণ বাজারও
রপ্তানি বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারও বাড়ছে। বিশেষ করে আবাসন ব্যবসার উন্নয়নের সঙ্গে হোম টেক্সটাইল খাতেও নতুন করে চাহিদা তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। একটি ফ্ল্যাটে দরজা-জানালার পর্দা, একাধিক বিছানার চাদর, কিচেন আইটেম, ডাইনিং আইটেমসহ বিভিন্ন রকমের হোম টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এতে হোম টেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড় আকার নিয়েছে।
হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এ বাজার আনুমানিক ১৫ হাজার কোটি টাকার। দেশের ২৪-২৫টি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উৎপাদন করে থাকে।
প্রধান বাজার বড় ব্র্যান্ড
বৈশ্বিক হোম টেক্সটাইলের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা। মোটের ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় দুই মহাদেশের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইলের ৮০ শতাংশ যায় এ দুই বাজারে। বিশ্বখ্যাত ক্যারফোর, ওয়ালমার্ট, আইকিয়া, আলদি, এইচঅ্যান্ডএম, মরিস ফিলিপস, হ্যামার মতো বড় ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশের হোম টেক্সের বড় ক্রেতা। অন্যান্য খুচরা ক্রেতার সংখ্যাও কম নয় বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি খাতের অন্যান্য পণ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে হোম টেক্সটাইল।
বাজার গবেষণা ও অ্যাডভাইজরি ফার্ম মরডর ইন্টেলিজেন্সের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মুনাফা হয় হোম টেক্সটাইল ব্যবসায়। মোট বিশ্ববাজার এখন ১৩১ বিলিয়ন ডলারের। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ১৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের এ প্রতিবেদনে।
প্রধান সমস্যা তুলা
হোম টেক্সটাইল খাতের বড় সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রধান কাঁচামাল তুলার সংকট এখনও বড় প্রতিবন্ধকতা। দেশে তুলা উৎপাদন বলতে গেলে হয় না। প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বেশির ভাগই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া ডাইং কেমিক্যালসহ অন্যান্য রাসায়নিক কাঁচামালের পুরোটা আমদানিনির্ভর।
‘এতে সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে। অথচ প্রতিযোগী প্রায় সব দেশের নিজস্ব তুলা আছে। তারপরও আমরা একেবারেই নিজেদের উদ্যোগে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে অবদান রেখে চলেছি’, বলেন হারুন-অর-রশিদ।
সবাই ব্যস্ত পোশাক খাত নিয়ে
দুঃখ করে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমাদের প্রতি কারও নজর নেই। না সরকার, না মিডিয়া। সবাই ব্যস্ত পোশাক খাত নিয়ে। সবকিছু ওদের জন্য।
‘আমরা যেন কেউ নই; কিছুই করছি না দেশের জন্য। অথচ সরকার যদি আমাদের দিকে একটু তাকাত, তাহলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসে দিতে পারতাম আমরা।’
একই সঙ্গে অবকাঠামো, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের সমস্যাগুলো কাটানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
১০ বছরের রপ্তানির চিত্র
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে ৭৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়ের অঙ্ক ছিল একটিু বেশি ৮৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
২০১৭-১৯, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল যথাক্রমে ৮৭ কোটি ৮৬ লাখ, ৭৯ কোটি ৯১ লাখ ও ৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
আগের তিন বছর ২০১২-১৩, ২০১১-১২ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ৭৯ কোটি ১৫ লাখ, ৯০ কোটি ৬০ লাখ এবং ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছিল।