দুই শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ নিয়মিতকরণের সুবিধা দেয়ায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৬৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপির তালিকা থেকে বাদ গেছে।
তবে সাবেক এই খেলাপিরা কিস্তি পরিশোধে আবার ছাড় পেয়েছেন। কারণ গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর কিস্তি না দিয়েও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি মুক্ত থাকা গেছে। আর এবার আগস্ট পর্যন্ত খেলাপিমুক্ত থাকা যাচ্ছে ২০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করলে।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের সমস্যা কাটাতে কিছুটা সুবিধা দিয়ে ২০১৯ সালে এই পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়া হয়। সেই সঙ্গে সুদ মওকুফের সুবিধাও যোগ হয়।
২০১৯ সালের মে মাসে ঋণ খেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ওই টাকা পরিশোধের সুযোগ দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই সুযোগ নিয়ে ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত বা পুনঃতফসিল করেছেন খেলাপিরা।
আর ২০১৯ সালে নিয়মিত করা হয় ৫২ হাজার ৭৬৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ঋণ।
মোট ২ বছরে ৬৬ হাজার ২৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে।
ঋণ পুনঃতফসিল বা মওকুফ সুবিধা দেয়ার দৌড়ে এগিয়ে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো। তবে সুবিধা দিয়েও খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পরেনি ব্যাংকগুলো। ফলে রাষ্ট্রীয় বেশিরভাগ ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ঋণখেলাপিরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। ঋণের অবস্থা, পরিশোধের ধরনসহ নানা বিষয় যাচাই-বাছাই করে এটি পুনঃতফসিলের যোগ্য কি না, তা সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক পর্ষদ।
সে সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপির সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই শতাংশ অর্থ আগাম পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ যারা নিয়েছিলেন, তাদেরও মহামারিকালের বিশেষ সুবিধার আওতায় সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেসব ঋণ খেলাপি ২০১৯ সালে যারা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ নিয়েছিলেন, তারাও ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কিস্তি না দিলে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হননি।
পরে সেই সুবিধা করা হয় জুন পর্যন্ত। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন সার্কুলারে জানায়, ঋণের কিস্তির ২০ শতাংশ পরিশোধ করলে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কাউকে খেলাপি ঘোষণা করা হবে না।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘কেউ যদি বারবার ঋণ পুনঃতফসিল আবেদন করে সেটা অবশ্যই খারাপ। আমরা অবশ্যই এটা অপ্রিশিয়েট করব না। কিন্তু জেনুইন কারণ যদি থাকে যে কোনো ইন্ডাস্ট্রি আটকে গেছে, সে ক্ষেত্রে সেসব ঋণ পুনঃতফসিল করা উচিত।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সবগুলোর পরিচালনা পর্ষদে সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা থাকে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত। অনেকের ওই পদে থাকার যোগ্যতা নেই, কিন্তু তারা হচ্ছে। ফলে ঋণের সুযোগ-সুবিধা তারাই নিচ্ছে বেশি। বেসিকসহ অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটা দেখা গেছে। এখানে সরকারের ইচ্ছাকৃত দূর্বলতা আছে।
‘সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এ সুযোগ নিচ্ছেন। তারা মনে করেন, আমরা কেন বাদ যাব? ব্যবসায়ীরাও এটার সুযোগ নিচ্ছেন।’
ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া এসব ঋণের টাকা আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০২০ সালে করোনার কারণে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন ছাড় দেয়া হয়েছে। ফলে পুনঃতফসিলের তেমন প্রয়োজন হয়নি।
ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ
রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ২০২০ সালে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ২ হাজার ৬৭৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১০ হাজার ৫০৭ কোটি ৭২ লাখ টাকার ঋণ নিয়মিতকরণ করেছে। আর সরকারি বিশেষায়িত কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ও প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক করেছে ২৭৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংক ঋণ নিয়মিত করেছে ৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
২০১৯ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল হয়েছে ১০ হাজার ৯৬১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ঋণ। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৩১ হাজার ২৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ঋণ নিয়মিতকরণ করেছে। আর সরকারি বিশেষায়িত তিন ব্যাংক করেছে ৫ হাজার ৯৬৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংক ঋণ নিয়মিত করেছে ৪ হাজার ৬০৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
ঋণের সুদ মওকুফ
২০২০ সালে ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে মওকুফ করা হয় ১ হাজার ৭৭১ কোটি ৭ লাখ টাকার সুদ।
২০২০ সালে সরকারি ছয় ব্যাংক ৬৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৫৬৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংক ৩৬১ কোটি ১১ লাখ টাকা ও বিদেশি ব্যাংকগুলো ৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে।
২০১৯ সালে সরকারি ব্যাংকগুলো মওকুফ করেছে ৭০৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৫০৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংক ২২১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ও বিদেশি ব্যাংকগুলো ৩৩৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে।