কালোটাকা হিসেবে পরিচিত অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বহাল করাকে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতার নামান্তর উল্লেখ করে ক্ষোভ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা বলছে, এর মাধ্যমে সৎ নাগরিকদেরও সরকার দুর্নীতিতে জড়াতে প্রলুব্ধ করছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সততা, নৈতিকতা ও সংবিধান পরিপন্থি বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
বুধবার এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, প্রস্তাবনায় না থাকার পরও অপ্রদর্শিত অর্থের মোড়কে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ বহাল করে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থবিল ২০২১ পাস হয়েছে।
এই বিলে নগদ টাকা থেকে শুরু করে সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকে রাখা টাকা, প্লট ও ফ্ল্যাট কিংবা নতুন বিনিয়োগের জন্য দেয়া সুযোগটিতে তথাকথিত বাড়তি কর ও নামমাত্র জরিমানা দেয়ার বিধান করা হলেও চূড়ান্ত বিচারে এটি দুর্নীতিবাজ ও এর পৃষ্ঠপোষকদের মাল্যদানসম উপহার হিসেবে বিবেচনা করছে টিআইবি।
গত ৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার বিষয়ে কিছু বলেননি। তখন টিআইবি সরকারকে সতর্ক ধন্যবাদ জানিয়েছিল।
তবে ২৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থবিল পাসের সময় জানানো হয় তালিকাভুক্ত শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটসহ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, নগদ টাকা, ব্যাংক ডিপোজিটের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করতে ২৫ শতাংশ হারে কর এবং মোট করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।
এ ছাড়া অঞ্চলভেদে জায়গা অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ও জরিমানা দিয়ে জমি, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে।
অন্যান্য বছর ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। এবার কর বাড়িয়ে যেটি করা হয়েছে, সেটি হলো টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। যা আগে ছিল না।
টিআইবি মনে কনে, বিনা প্রশ্নে দেয়া এ সুযোগ কালোটাকার মালিকদের আরও অবৈধ অর্থ উপার্জনের আইনগত গ্যারান্টি হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এটি যেকোনো বিচারে নৈতিকতাবিরোধী, দুর্নীতি সহায়ক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি বলেও মনে করে সংগঠনটি।
টিআইবি বরাবর অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেয়ার বিরুদ্ধে
দেশের মানুষের মধ্যে আয়কর নথি তৈরি না করার প্রবণতা আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে ৬১ লাখের মতো। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২৫ লাখ। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩ লাখ রিটার্ন আছে যাদের আয় শূন্য। তাদের কাছ থেকে কোনো কর পায় না সরকার। ফলে নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছে মাত্র ২২ লাখ।
বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত এখন ৮ শতাংশের কিছু বেশি। পাঁচ বছর আগেও তা ছিল ১৩ শতাংশের বেশি। সারা বিশ্বে সবচেয়ে কম অনুপাতের একটি বাংলাদেশ। প্রতিবেশী নেপাল-ভারতে এই হার অনেক বেশি।
মানুষের যে টাকার হিসাব আয়কর নথিতে উল্লেখ করা না হয়, সেটিই কালোটাকা। এ ছাড়া অবৈধ উপায় বা দুর্নীতির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা হয়। সরকার চাইছে ছাড় দিয়ে হলেও সেই টাকা হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসতে। নইলে এই টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ কারণেই সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়।
টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাজেট ঘোষণায় কোনো ধরনের উল্লেখ না থাকার পরও কীভাবে তা পুনরায় অর্থবিলে যুক্ত হলো?’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা নিয়ে সরকার এবার রীতিমতো অশুভ চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। কেননা ন্যায্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার নামে অর্থমন্ত্রী যে বিষয়টি প্রথমে বিবেচনা করেননি, তা কোন নৈতিকতার বিচারে চূড়ান্তভাবে রেখে দিলেন, সে ব্যাখ্যা তিনি অর্থবিল পাসের সময়ও দেননি।’
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ না রাখলেও অর্থবিলে সে সুযোগ দিয়েছেন
তিনি বলেন, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বিতর্ক ও সমালোচনা এড়াতেই সুযোগটি প্রাথমিকভাবে বাজেটে কোথাও রাখা হয়নি, যদিও এ বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় শুরু থেকেই ছিল। এটি শুধু বাজেট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেনি বরং সরকারের মাঝে জবাবদিহির সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্ত হওয়ার ইঙ্গিতও বহন করে। সরকারের এই পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ অঙ্গীকারকে পদদলিত করছে।”
এবার কালোটাকা বিনিয়োগে কর ও জরিমানা আরোপের বিষয়ে টিআইবি-প্রধান বলেন, ‘কর ও জরিমানা ধার্য করে সরকার যে বার্তাই দিতে চাক না কেন, এর ফলে যে অনৈতিকতা ও দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ বর্ধিত মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করল, তার বিনিময় মূল্য কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না।
‘এতে সাময়িকভাবে কিঞ্চিৎ বেশি কর পাওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও এর বিপরীতে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বার্থান্বেষী শক্তির কাছে সরকারের যে নৈতিক পরাজয় ঘটল, তা সত্যিই শঙ্কিত হওয়ার মতো। সরকারের এই অবস্থান বৈষম্যমূলক, দুর্নীতি সহায়ক ও সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা কখনো কাম্য হতে পারে না।’
নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে এমন সুযোগ আগে থেকে রাখা হলেও এর মাধ্যমে কত অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে কিংবা আদৌ হয়েছে কি না, তার কোনো হিসাব সরকার কখনও প্রকাশ করেনি। সরকার একদিকে কালোটাকার মালিকদের নতুন করে কালোটাকা তৈরির আইনি গ্যারান্টি দিচ্ছে; অন্যদিকে সৎ নাগরিকদের প্রলোভিত করছে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে।
‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, দেশে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ উচ্চতর মাত্রা পেতে যাচ্ছে, যা সত্যিই চরম হতাশার।’