ঠিক ৪ এপ্রিলের মতো ঘটনা। পরের দিন থেকে লকডাউন, এই আতঙ্কে পুঁজিবাজারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে নাই ১৮১ পয়েন্ট।
একই চিত্র সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার। শাটডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া কঠোর লকডাউন শুরুর কথা ছিল সোমবার থেকে। পরে তা পিছিয়ে বৃহস্পতিবার করা হয়েছে। আর এই ঘোষণার পর প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকে হলো বড় পতন। আতঙ্কে কম দামে শেয়ার বিক্রি করেছেন বিনিয়োগকারীরা। আর দিন শেষে নাই ১০০ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে বেড়েছে ৫৪টির, কমেছে ৩০৬টির দাম। আর অপরিবর্তিত ছিল ১২টির দর।
সূচক নামল গত ৭ জুনের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে। সেদিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৭৫ পয়েন্টে।
প্রায় তিন মাস আগে যখন প্রথম বিধিনিষেধ বা লকডাউন শুরু হয়, তার আগে আগে এভাবে আতঙ্কে পতন হলেও পরে বিনিয়োগকারীরা দেখেছেন সুদিন।
বিধিনিষেধের পৌনে তিন মাসে আকর্ষণীয় মুনাফা পেয়েছেন তারা। প্রথমে বিমা, পরে ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এরপর বস্ত্র ও প্রকৌশল খাতে উত্থান দেখেছেন তারা। বেশিরভাগ কোম্পানির দামই বেড়েছে এই সময়ে।
এই অভিজ্ঞতার পরেও আগামী ১ জুলাই থেকে শাটডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া কঠোর লকডাউন শুরু হতে যাওয়ার আগে আগে সেই এপ্রিলের শুরুর মতোই আতঙ্ক পুঁজিবাজারে। কোনো খাত নিয়ে নেতিবাচক তথ্য না থাকার পরেও পুঁজিবাজারে ঢালাও মূল্য পতন হয়েছে প্রায় সব খাতেই। এর পেছনে শাটডাউন আতঙ্ক কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সে সময়ও লকডাউন হলে পুঁজিবাজারে লেনদেন চলবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। তেমনি আশ্বাসও ছিল। এবারও তাই। বিনিয়োগকারীদের একাংশের মধ্যে শঙ্কা, লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনি ব্যাংক ও পুঁজিবাজার চালু থাকার আশ্বাসও আছে।
এক দিনে বড় পতনে মূল্য সূচক প্রায় এক মাস আগের অবস্থানে নেমে এসেছে। তবে লেনদেন আগের কর্মদিবসের মতোই আছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, শাটডাউনে পুঁজিবাজার পড়ে যাবে, এমন আশঙ্কা থেকেই অনেকে শেয়ার বিক্রি করেছেন।
তবে আবার একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন বহুজন। বিও হিসাবে নগদ টাকা ছিল যাদের, তারা শেয়ার কিনেছেন। আর এ কারণেই আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা।
গত ৫ এপ্রিল প্রথমবারের মতো লকডাউন শুরু হওয়ার ঘোষণায় ৪ এপ্রিল পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক পড়ে ১৮১ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে নাই হয়ে যায় হারায় ৫৪২ দশমিক ০৬ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
সেদিন এত দরপতনের কারণ ছিল, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা জন্মেছিল যে লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকবে। তবে সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ব্যাংক চালু থাকবে আর এরপর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, লেনদেন চলবে পুঁজিবাজারেও।
পর দিনই বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। লকডাউন শুরুর দিন সূচক বাড়ে ৮৯ পয়েন্ট, তার পর কর্মদিবসে বাড়ে আরও ১০৭ পয়েন্ট।
রোববারের আগে শেষ কার্যদিবস ২৪ জুন পর্যন্ত সূচকে যোগ হয় এক হাজার ৪ পয়েন্ট।
এই অভিজ্ঞতার পরেও এবারও কঠোর বিধিনিষেধের আতঙ্কে সেই ৪ এপ্রিলের মতোই লেনদেনের শুরুতেই শেয়ার দর পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও কখনও আগের দিনের সূচক ৬ হাজার ৯২ পয়েন্টের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। আর শেষ এক ঘণ্টায় বাজার কেবল পড়েছেই।
অথচ লকডাউনের আগের মতোই জানা যাচ্ছে শাটডাউনেও ব্যাংক খোলা থাকবে সীমিত সময়ের জন্য। আর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তার আগের নীতিতেই আছে। অর্থাৎ ব্যাংক খোলা থাকলে লেনদেন চলবে পুঁজিবাজারেও।
ব্যাংক-বিমায় ধস
গত এক বছরে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর বিমা খাত কয়েক দিন ধরেই সংশোধনে ছিল। এর মধ্যে যোগ হলো শাটডাউন আতঙ্ক। দুয়ে মিলে আরও একটি ধস দেখা গেল এই খাতে। সবচেয়ে বেশি দর হারানোর তালিকায় এই খাতের প্রাধান্যই ছিল সবচেয়ে বেশি।
সব মিলিয়ে ৫০টি কোম্পানির মধ্যে ৪৪টির দামই কমেছে। বেড়েছে কেবল ৫টির আর অপরিবর্তিত ছিল একটির দর।
সবচেয়ে বেশি দর হারানো ১০টি কোম্পানির ৬টি আর ২০টির মধ্যে ১৩টি ছিল বিমা খাতের।
শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি কমেছে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের দর। কোম্পানিটি ১২.০৭ শতাংশ দাম হারিয়েছে। এক দিনে ১০ শতাংশের বেশি দর না কমার সুযোগ না থাকলেও কোম্পানিটি লভ্যাংশ সংক্রান্ত সমন্বয়ের কারণে এই পরিমাণ কমতে পেরেছে।
এ ছাড়া শেয়ার প্রতি ২ টাকা করে নগদ ও সঙ্গে পাঁচ বছর পর প্রতি ১০টি শেয়ারে একটি বোনাস দেয়ার ঘোষণা দেয়া পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স দর হারিয়েছে ৯.৬ শতাংশ।
সোনার বাংলা ৯.৩২, অগ্রণী ৮.৮, প্রগতি ৮.৫, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স দর হারিয়েছে ৮.২ শতাংশ।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে ১৯১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল ১৮৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বেশি দর কমার তালিকায় না থাকলেও ব্যাংক খাতেও দেখা গেছে করুণ চিত্র। এই খাতে দাম বেড়েছে কেবল ৩টির, কমেছে ২৫টির। আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি ৩টির।
সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বাড়া এনআরবিসি। আগের দিনের চেয়ে ৬.১৯ শতাংশ দর কমেছে ব্যাংকটির।
এ ছাড়া মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪.১৬ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ৪.০২ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের ৩.০৪ শতাংশ, ইউসিবির ২.৯৭ শতাংশ দাম কমেছে। বাকিগুলোর দাম কমার হার খুব একটি বেশি নয়।
পতনের দিন ব্যাংক খাতে ডাচবাংলা ব্যাংকের ২ টাকা ৬০ পয়সা এবং আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের দাম বেড়েছে ১০ পয়সা।
ব্যাংক খাতে হাতবদল হয়েছে ১৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১৯৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
ধস বিদ্যুৎ, প্রকৌশল, ওষুধ খাতেও
অর্থবছর শেষ হতে চলা এই তিন খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ এবং ওষুধ খাতে কেবল একটি করে আর প্রকৌশল খাতে কেবল ৩টি শেয়ারের দাম বেড়েছে। বিবিধ খাতেও বেড়েছে কেবল একটির দর।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতে ২১টির, ওষুধ খাতে ২৯টি আর প্রকৌশল খাতে ৩৯টি আর বিবিধ খাতে কমেছে ১৩টির দর। ফলে সহজেই অনুমেয় যে, এসব খাতের শেয়ারধারীরাও ব্যাপকভাবে হতাশ।
দাম কমার ক্ষেত্রে যেসব কোম্পানি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ভালো মুনাফা করেছে আর যেসব কোম্পানি ভালো করতে পারেনি, তার মধ্যে কোনো পার্থক্যই দেখা যায়নি।
প্রকৌশল খাতে লেনদেন হয়েছে ১২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আগের দিন যা ছিল ১২১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ওষুধ ও রসায়ন খাতে হাতবদল হয়েছে ১০৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
প্রায় শতভাগ পতন মিউচ্যুয়াল ফান্ডে
অর্থবছর শেষ হতে যাওয়া মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের ৩৭টি ফান্ডের মধ্যে একটির লেনদেন হয়নি। বাকি ৩৬টির সবগুলো দর হারিয়েছে।
এই ফান্ডগুলোর ৩০টির অর্থবছর শেষ হতে চলেছে আগামী ৩০ জুন। আর এর মধ্যে সিংহভাগ ফান্ডই চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাপক মুনাফা করার তথ্য প্রকাশ করেছে। আর ১ এপ্রিল থেকে শুরু চতুর্থ প্রান্তিকে এখন পর্যন্ত ৭৫০ পয়েন্টের মতো সূচক বৃদ্ধির সুফলও তারা পাবে।
এই অবস্থায় গত কয়েক দিনে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এক দিনে লেনদেন হওয়া সব কটি ফান্ডের দর বৃদ্ধির চিত্রও দেখা গেছে পুঁজিবাজারে। অথচ উল্টোচিত্র দেখা গেল আতঙ্কের দিন।
শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি কমেছে ফিনিক্স ফিনান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর। আগের দিনের তুলনায় ৭.২৭ শতাংশ কমেছে এর ইউনিট দর।
এসইএমএল আইবিবি শরিয়া ফান্ড ৪.৬৯ শতাংশ, সিএপিএম বিডিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান ৪.৬৩ শতাংশ, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪.৬১ শতাংশ, ভ্যানগার্ড এএমএল বিডি ফিনান্স মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান ৪.৪ শতাংশ, এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়েটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড ৪.৩৯ শতাংশ, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৪.৩৫ শতাংশ দর হারিয়েছে।
পতনের দিন উজ্জ্বল কেবল বস্ত্রখাত
যে ৫৪টি কোম্পানির দর বেড়েছে তার মধ্যে এই একটি খাতেরই ২৩টির দর বৃদ্ধিই বলে দেয়, এই খাতের শেয়ারধারীদের মধ্যে হতাশার বোধ কম। আর সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই খাতেরই প্রাধান্য দেখা গেছে।
সবচেয়ে বেশি দর বাড়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৬টি আর ২০টির মধ্যে ১৫টি ছিল বস্ত্র খাতের। ওটিসি থেকে মূল মার্কেটে ফেরা মুন্নু ফেব্রিক্স তমিজউদ্দিন টেক্সটাইলের দাম আবারও বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
দিনের দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে মতিন স্পিনিং, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, আরগন ডেনিম, জাহিন স্পিনিং, হাওয়েল টেক্সটাইলের দরও।
দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমার কাছাকাছি বেড়েছে ঢাকা ডায়িং, কুইনসাউথ, জাহিন টেক্সটাইল, শাসা ডেনিমের দরও।
এই খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত এক মাসে ব্যাপকভাবে দাম বৃদ্ধি পাওয়া সাফকো স্পিনিং দর হারিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি দর হারানো ১০টি কোম্পানির একটি ছিল এই কোম্পানিটি। এর বাইরে এমএল ডায়িং, পিটিএল, দুলামিয়া কটন, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজও দর হারিয়েছে তিন থেকে চার শতাংশের মাঝামাঝি।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে ৪৬১ কোটি ৩ লাখ টাকার। যা আগের দিন ছিল ৪৩৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১০০ দশমিক ১০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৯২ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস সূচক ১৪ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৮৭ পয়েন্টে।
রোববার পুঁজিবাজারে লেনদেনের চিত্র
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৩০ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৮ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মোট ১ হাজার ৭৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল এক হাজার ৫৯৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই আগের দিনের তুলনায় ২৯৭ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মোট ২১০ কোটি টাকা।