করোনাভাইরাস উত্তর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের এখন গতিপথ পরিবর্তনের সময়, যার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য আসবে এবং রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
বুধবার প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এবং বিশ্বব্যাংক প্রণীত ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়গনস্টিক (সিপিএসডি)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পরামর্শ দেয়া হয়।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতগুলো আরও শক্তিশালী করা দরকার। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থনীতির সম্ভাবনার বন্ধ দরজাও খুলবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেখানে ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল, বাংলাদেশের সেখানে ৭০ শতাংশ। ফলে একটি বিস্তৃত বেসরকারি খাত গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে দেশের আর্থিকখাতে নতুন দফার সংস্কার শুরু করতে হবে।
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সাফল্যের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পরবর্তী দশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাংলাদেশের এখন গতি পরিবর্তনের সময় হয়েছে।
‘বাংলাদেশকে এখন নতুন দফার সংস্কার শুরু করতে হবে। এই সংস্কার এজেন্ডার প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর্থিক খাতের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ। একই সঙ্গে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণ।’
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অর্থনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে সুযোগগুলো কাজে লাগালে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের আগামীর বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। বিনিয়োগ সম্ভাবনার এই খাতগুলো হচ্ছে: পরিবহন ও লজিস্টিকস, জ্বালানি, আর্থিক সেবা, হালকা প্রকৌশল, কৃষি বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করা হয়। এতে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইএফসির এশিয়া ও প্যাসিফিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফনসো গার্সিয়া মোরা, বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন এবং বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে নিযুক্ত আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি ওয়ার্নারসহ আরও অনেকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৪০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এবং সরকারের দূরদর্শী নীতির সহায়তায় রেমিট্যান্সের তেজি প্রবাহ বাংলাদেশের দৃঢ় ও প্রাণবন্ত প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি অতিমারির সময়েও।
বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা (২০২১-৪১) অনুযায়ী সরকার ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে সবার কর্মসংস্থান ও চরম দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিপিএসডি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। পাশাপাশি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা থেকে বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ভার্চুয়াল সংলাপে দাবি করা হয়, এই প্রতিবেদনের ফলাফল বাংলাদেশ সরকারের সাথে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের নতুন কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের কৌশলগত উপাদান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, যা বাজার সৃষ্টি এবং বেসরকারি খাতের সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণের পথ দেখাবে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘করোনার অতিমারির প্রতিকূল প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে মন্দার কবলে পড়েনি। সেই সঙ্গে ইতিবাচক জিডিপি প্রবৃদ্ধিও এসেছে গত বছর। কারণ, আমরা এই অতিমারির সমস্ত চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় রেখে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি।’
সালমান এফ রহমান জানান, সিপিএসডি রিপোর্টের সুপারিশগুলো ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে যেতে সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অগ্রাধিকারগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আইএফসির এশিয়া ও প্যাসিফিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফনসো গার্সিয়া মোরা বলেন, ‘অতিমারি বাংলাদেশের ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে। দেশটি এখন করোনা উত্তরণের পর্যায়ে থাকায় সংস্কারের প্রয়োজনীতা আরও দৃঢ়ভাবে দেখা দিয়েছে।
‘এখন দরকার একটি মজবুত আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখন অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে এই বেসরকারি খাতের আরও জোরালো ভূমিকা রাখার দরকার, যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি গুনগত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।’
বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, ‘রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আরও প্রাণবন্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। একই সঙ্গে একটি বলিষ্ঠ ও অত্যাধুনিক বেসরকারি খাত গড়ে তুলতে হবে, যা করোনা পরবর্তী পুনরুদ্ধার পর্যায়ের জন্য খুবই জরুরি। যেখানে সরকারের বেশির ভাগ সম্পদের প্রয়োজন হবে সামাজিক খাতের জন্য।’
বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে নিযুক্ত আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি ওয়ার্নার বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে, গুনগত স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে এবং স্বাস্থ্য পরিসেবার দক্ষতা বাড়াতে বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেননা একই পর্যায়ের উন্নয়নে থাকা অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন কম মাত্রার।’
তিনি বলেন, ‘এর বাইরে বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যের তৈরি পোশাকের বাজারে মনোযোগ দিতে পারে ও নতুন প্রযুক্তির প্রবর্তন করতে পারে এবং পাদুকা, চামড়া, ইলেকট্রিক সামগ্রী এবং কৃষিবাণিজ্য রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।’