দুই দিনের নানা সংশয় কাটিয়ে বিমা খাত হারানো দাম ফিরে পেল। এই খাতে অবিশ্বাস্য উত্থান অব্যাহত থাকার পাশাপাশি ব্যাংক খাতেও দর সংশোধন অবসানের আভাস মিলল। সেই সঙ্গে চাঙ্গাভাব বস্ত্রখাতেও।
তিনে মিলে সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের দিন রোববার থেকে পুঁজিবাজারে যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছিল, সেটি কাটিয়ে সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে দেখা গেছে উত্থান।
সোমবার সূচক যতটা হারিয়েছিল, ততটা ফিরে না পেলেও প্রায় ৫০ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ অনেকটাই কাটিয়ে দিল।
২০১০ সালের মহাধসের পর থেকে পুঁজিবাজার কখনও কখনও ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিলেও তা স্থায়ী হতে পারছিল না। গত বছর করোনা সংক্রমণের পর ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি কাটিয়ে জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা বেড়েছে বাজার।
এরপর তিন মাসের সংশোধনে আট শ পয়েন্টের বেশি সূচক পড়ে যাওয়া নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়, সেটি ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে ৫ এপ্রিল লকডাউনের শুরু থেকে। আর টানা দুই মাসের উত্থানে সূচক প্রথমবারের মতো ছয় হাজার পয়েন্টের ঘরও অতিক্রম করে গত সপ্তাহে।
তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ২০১০ সালের মহাধসের সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় গত রোববার। তবে সেদিন সূচক পড়ে যাওয়া, ব্যাংক-বিমা খাতের দরপতন ভাবিয়ে তোলে বিনিয়োগকারীদের। কারণ, দর সংশোধনের দিন পতন সব সময় ভালো ইঙ্গিত বহন করে না পুঁজিবাজারে।
বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ আরও বেড়ে যায় সোমবার। সেদিনও ব্যাংক-বিমার পতনে এক পর্যায়ে সূচক পড়ে যায় ৮২ পয়েন্ট। তবে লেনদেন কমে যাওয়া আর শেষ বেলায় ২০ পয়েন্টের মতো সূচক ফিরে পাওয়া কিছুটা হলেও স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে।
সেদিন সূচক আবার ছয় হাজার পয়েন্টের নিচে চলে আসে।
মঙ্গলবার দিনের শুরুতে সূচক আবার ছয় হাজার পয়েন্টের ওপরে উঠলেও পরে তা পাঁচ হাজার ৯৩৭ পয়েন্টে নেমে আসে। ততক্ষণে টানা তিন দিনের মতো ব্যাংক খাতে বড় দরপতনের চিত্র দেখা দেয়।
তবে দিনের শুরু থেকেই বিমা খাত ছিল চাঙা। দুই দিনের পতনে কোম্পানিগুলো যে টাকা দর হারিয়েছিল, তা ছাড়িয়ে যায় বেশির ভাগ কোম্পানিই। দিন শেষেও তা অব্যাহত থাকে।
আবার শেষ বেলায় ব্যাংক খাতও পতনের লাল রং মুছে গিয়ে দর বৃদ্ধির সবুজ রঙে ফিরে আসে।
দিন শেষে সূচক বাড়ে ৪৭ পয়েন্ট। সংশোধনের আশঙ্কায় থাকা বাজারে লেনদেন আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও তা দুই হাজার কোটি টাকার বেশিই হয়েছে।
এ নিয়ে টানা পাঁচ দিন দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলো পুঁজিবাজারে, যেটি গত ১০ বছরের ইতিহাসে বিরলই বলা যায়।
বিমায় দুই দিনে যত কমল, একদিনেই বাড়ল তার চেয়ে বেশি
সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবসে দর হারানোর আগে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের দর ছিল ৮৬ টাকা ৪০ পয়সা। এক দিনের উত্থানে সেই পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না কোম্পানিটির পক্ষে। তবে যতটা বাড়া সম্ভব, ততটাই বেড়ে হয়েছে ৮৫ টাকা ২০ পয়সা।
তবে সংশোধনের আগে ৫০ টাকা ৩০ পয়সা ছাড়িয়ে গেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের দর।
৪৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে চার টাকা ২০ পয়সা বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ৫১ টাকা ৭০ পয়সা।
১১১ টাকা থেকে কমে ৯৮ টাকায় নেমে আসা এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের দর ৯ টাকা ৮০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১০৭ টাকা ৯০ পয়সা।
আর সংশোধনেও দর না হারানো তিন কোম্পানি ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স আর প্রগতি লাইফ দিয়েছে আরও লাফ।
ঢাকার দাম প্রায় ১০ শতাংশ বা ১০ টাকা ২০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা।
পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের দাম ১৪ টাকা ২০ পয়সা বা ৮.৫৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৮০ টাকা ৪০ পয়সা।
প্রগতি লাইফের দাম ১১ টাকা ৪০ পয়সা বা ৯.৬১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা।
সব মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি দর বাড়া ২০টি কোম্পানির মধ্যে ১১টিই বিমা খাতের দেখা গেছে।
এই খাতের ৫০টি কোম্পানির মধ্যে কেবল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স ৮০ পয়সা দর হারিয়েছে। বাকি সবগুলোরই বেড়েছে। এর মধ্যে নয়টির দাম বেড়েছে একদিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
চাপ কাটল ব্যাংক খাত
২০১৭ সালের পর ঘুমিয়ে থাকা ব্যাংক খাত এবার লভ্যাংশ দিয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বোনাস শেয়ারের পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঞ্চয়ের সুদহারের চেয়ে বেশি হারে নগদ লভ্যাংশ পেয়ে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন।
অথচ করোনাকালে ব্যাংকের লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আদেশ ছাড়িয়েছিল আশঙ্কা।
কেবল ভালো লভ্যাংশ নয়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক ঘোষণা করেছে যেসব কোম্পানির তার মধ্যে বেশির ভাগেরই আয় বেড়েছে গত বছরের চেয়ে বেশি। কোনো কোনোটির হয়েছে দেড় গুণ, কোনোটির দ্বিগুণ, কোনোটির তিন গুণ।
এই অবস্থায় গত মাসে এই খাতেও দেখা দেয় চাঙাভাব। একটি ব্যাংকের শেয়ার দাম তিন গুণ হওয়ার পাশাপাশি ৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বাড়ে আরও বেশ কিছু ব্যাংকের শেয়ার দর।
তবে গত সপ্তাহ থেকেএই এই খাত যায় সংশোধনে। টানা তিন দিন পতনের পর গত ২ জুন এই খাত ঘুরে দাঁড়ালেও এর পর আবার তিন দিন পড়েছে একটানা। এর মধ্যে রোববার এক দিনে সব কটি ব্যাংক এক দিনে দর হারানোর পর দিনও দুই একটি ছাড়া সবগুলোর পতন এই খাত নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করে।
আরও দিনভর সিংহভাগ ব্যাংক দর হারিয়ে ফেলে। তবে বেলা দুইটার পর থেকে দাম বাড়তে থাকে ব্যাংকের শেয়ারেরও।
এক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকায় উঠে আসে ডাচ বাংলা ব্যাংকের শেয়ার। আগের দিনের চেয়ে ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই দাম বেড়েছে এই কোম্পানিটির। আগের দিনের চেয়ে ৭ টাকা বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা।
ব্যাংক খাতে দর বৃদ্ধি যে কোম্পানিকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই এনআরবিসির দরও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। আগের দিনের চেয়ে তিন টাকা ২০ পয়সা বা ৯.০৯ শতাংশ বেড়েছে। ৩৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে দাম হয়েছে ৩৮ টাকা ৪০ পয়সা।
সব মিলিয়ে এই খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ২১টির। কমেছে চারটির, বাকি ছয়টির দাম ছিল অপরিবর্তিত।
অন্যান্য খাতের কী অবস্থা
ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির দামই আজ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ইসলামিক ফিন্যান্স ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্সের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ।
সব মিলিয়ে এই খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১৪টির। একটির লেনদেন স্থগিত। বাকি আটটির মধ্যে দর হারিয়েছে ছয়টি, দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
বাজেটে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করার পর থেকে বস্ত্র ও প্রকৌশল খাতে যে চাঙাভাব দেখা দিয়েছে, সেটি টানা তৃতীয় দিনের মতো অব্যাহত আছে।
তিনটি কোম্পানি দিনে দাম বৃদ্ধির প্রান্তসীমা ছুঁয়েছে। এর মধ্যে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং এর ৯.৯৭ শতাংশ, রানার অটোর ৯.৯৬ শতাংশ আর কপারটেকের দাম বেড়েছে ৯.৮৭ শতাংশ। এক দিনে কোম্পানি দুটির দাম এর চেয়ে বেশি বাড়া সম্ভব ছিল না।
সব মিলিয়ে এই খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২১টির। কমেছে ১৯টির, আর দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
বস্ত্র খাতের ৫৬ কোম্পানির মধ্যে দিনে দাম বৃদ্ধির প্রান্তসীমা ছুঁয়েছে তিনটি কোম্পানির। এগুলো হলো তসরিফা, সাফকো আর বন্ধ থাকা রিংসাইন টেক্সটাইল, যেটি পর্ষদ পুনর্গঠনের পর উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় আছে।
সব মিলিয়ে এই খাতে দাম বেড়েছে ৩০টি কোম্পানির। কমেছে ১৭টির দাম আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি নয়টির।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন বেক্সিমকোরই
গত কয়েক মাস ধরেই এই বিষয়টি দেখা যাচ্ছে। হাতে গোনা এক দুই দিন ছাড়া এই কোম্পানিটিই সবচেয়ে হাতবদল হয়ে আসছে প্রতি দিন।
দুই দিন আগে কোম্পানিটির তিন শ কোটি টাকার শেয়ার হাতবদল হলেও সে তুলনায় অবশ্য সোমবার আগ্রহ কম ছিল। এদিন বিক্রি হয়েছে ১৫৪ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৭৬ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার টাকার।
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে ছিল যথাক্রমে ফরচুন সুজ, লংকাবাংলা ফিন্যান্স ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স।
সূচক ও লেনদেন
দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক বা ডিএসইএক্স এর অবস্থান দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৩ পয়েন্ট।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানিগুলোর সূচক এক পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৯০ পয়েন্টে।
বাছাই করা ৩০টি কোম্পানির সূচক ০.৮৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১৯৫ পয়েন্ট।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেড়েছে ১৮১টির দর, কমেছে ১৪৫টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৪৩টির দর।
লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৬৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬২ হাজার টাকার। এটি আগের দিনের চেয়ে সামান্য কম। সোমবার হাতবদল হয়েছিল দুই হাজার ৮৩ কোটি টাকার কিছু বেশি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই আগের দিনের তুলনায় ১১৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৩১ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৮৫ কোটি টাকা। এদিন সিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৪৮টির, কমেছে ১১১টির। দর পাল্টায়নি ৪১টির।