বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি হলে দরিদ্র মানুষের ভাতা কেন সে দেশের চেয়ে কম- এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে।
করোনাকালে দেয়া বাজেটে সরকার এক কোটির বেশি মানুষকে ভাতার আওতায় আনার যে পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলছে তারা।
প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে বাজেট পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, মাসে ৫০০ টাকা বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। কারণ, মাথাপিছু আয়ে পিছিয়ে থাকা ভারত তার দেশের গরিবদের এর চেয়ে বেশি হারে ভাতা দেয়।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন। ওই বাজেটের ওপর প্রতিক্রিয়া জানাতে রোববার 'জাতীয় বাজেট ২০২১-২২: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী আছে’ শীর্ষক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে ব্রিফিংয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম অংশ নেন।
উপকারভোগী, ভাতা- দুটোই বাড়ানোর পরামর্শ
এতে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘করোনা বিবেচনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ভালো বাজেট হয়নি। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার দাবি তোলা হলেও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, নতুন দরিদ্র, ভোক্তা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এমনকি এলাকাসহ উপকূলীয় এলাকা ও চর এলাকার মানুষরা এ বাজেট জায়গা পায়নি।
তিনি বলেন, 'সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে পেনশন, ছাত্রবৃত্তি, নিয়মিত খাদ্যসহায়তা হিসাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে বাজারে প্রায় ১৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তবে পেনশন বাদ দিলে তা দাঁড়ায় ১৪ শতাংশের মতো। সেই হিসাবে করোনাকালীন সময়ের বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়নি। যতটুকু বেড়েছে তা পেনশন খাতে, অন্য খাতে তেমন বাড়েনি।’
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ-এর ভার্চুয়াল বাজেট মূল্যায়নে বক্তারা
তথ্য-উপাত্ত না থাকার কারণে করোনার কারণে নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়া মানুষদের পরিসংখ্যান বাজেটে আসেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা দরকার ছিল।’
বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি হলেও দরিদ্রদের ভাতা সে দেশের চেয়ে কম কেন, সে প্রশ্ন রাখেন দেবপ্রিয়।
তিনি জানান, ভারতে ৬০ থেকে ৭৯ বছর বয়স্কদের ভাতা ৬০০ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় ৭২০ টাকার মতো। সে দেশে ৮০ বছরের ওপরে বয়স্করা ১২০০ রুপি ভাতা পান। কিন্তু বাংলাদেশে এটি মাসে ৫০০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক কম। তাহলে আমাদের মাথাপিছু আয় বেশি হলেও আমরা কেন ভারতের দরিদ্রদের চেয়ে কম ভাতা পাব? এই মাথাপিছু আয় বা বাড়ার সুফলটা কাদের ভাগে যাচ্ছে, প্রশ্ন উঠতেই পারে।’
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। আর ভারতের আয় ১ হাজার ৯৪৭ ডলার।
তথ্য পরিসংখ্যান নিয়ে সংশয়
দেবপ্রিয় বলেন, যদি জাতীয় আয় বেশি করে দেখানো হয়, যা সঠিক হয়নি। তাহলে ভবিষ্যতে যখন দেশ এলডিসি থেকে বের হবে, তখন অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।
তবে সত্যিকারে জাতীয় আয় বেশি হলে তা ভালো খবর বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আগের বছর ৫৩ লাখ মানুষ বিদেশে গেলেও এবার গেছে মাত্র দুই লাখ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাহলে কীভাবে গত বছরের চেয়ে এ অর্থবছর ভালো হতে পারে?’
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের চেয়ে এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। ৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
দেবপ্রিয় বলেন, ‘দেশের সামষ্টিক বিনিয়োগ বাড়বে, এমনকি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে, তা কীভাবে সম্ভব?’
বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপের সমালোচনা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ কর আরোপের যে ঘোষণা অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, সেটি উচিত হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেরা কর দেয় না। অন্যদের কাছ থেকেই আদায় করে। এই কর শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তাবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘করোনায় যারা পিছিয়ে পড়েছে, সেই শিক্ষার্থীদের জন্য কী দিল সরকার? চার কোটি শিক্ষার্থী, তাদের পরিবার, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষসহ দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেসব শিক্ষক এখন কঠিন আর্থিক সংকটে রয়েছেন, তারা যদি শিক্ষা পেশা ছেড়ে চলে যান, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও পাঠদান করবে কারা?’
তিনি বলেন, ‘বাজেট ব্যবসাবান্ধব হতে পারে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এটা শিক্ষাবান্ধব নয়। শিক্ষাক্ষেত্রের এই প্রজন্মের যে বিপর্যয় ঘটেছ, তার জন্য কিছুই নেই। আশা করি, সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে।’
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনা মাথায় রেখে নগদ সহায়তাভোগীর সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। এমনকি তা আরও বেশিবার দেয়া এবং সহায়তা পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।’
নতুন করে যারা দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছেন, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও তাগিদ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ মুশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, করোনার ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ থাকলেও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যেই সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা আবশ্যক হলেও বাজেটে অর্থমন্ত্রীর যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেই হিসাব করলে আরো পাঁচ বছর লাগবে।
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের বড় অংশ অপচয় হয়। শ্রীলঙ্কা আমাদের চেয়ে চার গুণ বিনিয়োগ করে। আমরা জানি না কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের টাকা খরচ করতে পারে না।’
প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদের ওপর সারচার্জ বাড়ানোকে সমর্থন করেছে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। তারা বলছে, কোনো দেশে ব্যক্তির ওপর কর বসিয়ে বৈষম্য কমানো যায় না, কিন্তু ধনীদের সম্পদের ওপর কর বসিয়ে বৈষম্য কমানো যায়।’