সাতটি ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায়। আরও চারটির দর এই সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে কিছুটা কমেছে। আরও তিনটির দর সর্বোচ্চ সীমার কাছাকাছি গিয়ে কিছুটা কমেছে।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধসের পরে ব্যাংক খাতে নানা সময় কিছু সময়ের মধ্যে দর বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেলেও এমন অবস্থা এর আগে দেখা যায়নি।
বৃহস্পতিবার ব্যাংকের শেয়ারের দর বৃদ্ধির ওপর ভর করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক এক দিনেই বাড়ল ১০১ পয়েন্ট। লেনদেন ১০ বছরের রেকর্ড ছুঁইছুঁই।
- আরও পড়ুন: এফডিআরের চেয়ে ব্যাংকের শেয়ারে মুনাফা বেশি
- আরও পড়ুন: সময় এখন ব্যাংকের, নতুন উচ্চতায় লেনদেন
গত ১৭ জানুয়ারি ২ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকার পরে আজ হাতবদল হলো ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার শেয়ার। ২০১০ সালে মহাধসের পর গত বছরের ২৮ জুন আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও সেটির কারণ ছিল ভিন্ন। জেএসকেবিডির সব শেয়ার সেদিন কিনে নেয় ইউনিলিভার বাংলাদেশ। ব্লক মার্কেটে হাতবদল হওয়া সেই শেয়ার সামগ্রিকভাবে লেনদেন বেশি দেখিয়েছে।
সকাল ১০টায় লেনদেন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আগের দিনের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ দাম বেড়ে যায় এবি ও ওয়ান ব্যাংকের। তখনই বোঝা যাচ্ছিল এই খাত আবার ভালো করবে।
গত এক মাসে এবি ব্যাংকের দাম বাড়ার চিত্র
মহামারির বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে যাওয়ার খবর আসার পর চলতি বছর লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমে এই খাতের শেয়ার দর আরও কমে যেতে থাকে। এমনিতেই অবমূল্যায়িত এই খাতের শেয়ার দর হারানোর প্রভাবে সূচকও কমে যায় ব্যাপক হারে।
তবে পরে দেখা যায়, ব্যাংকের চূড়ান্ত মুনাফা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো যে হারে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, সেটি আমানতের সুদহারের চেয়ে বেশি।
গত পাঁচ বছর ধরেই বিভিন্ন ব্যাংক যে হারে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করছে, তাতে ব্যাংকে এফডিআর করার চেয়ে শেয়ার কিনে রেখেই বেশি টাকা পাওয়া গেছে।
৩১টি ব্যাংকের মধ্যে যে ২৭টি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তাদের মধ্যে ২৩টি এবার দুই হাজার তিন শ কোটি টাকারও বেশি নগদে বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে। তিনটি ব্যাংক কেবল বোনাস লভ্যাংশ দেবে আর একটি দেবে না। আরও চারটির লভ্যাংশ ঘোষণা বাকি আছে।
আবার চলতি বছর এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংক প্রথম প্রান্তিক ঘোষণা করেছে, তাতে দেখা যায়, এবার ব্যাংকগুলো আরও বেশি মুনাফা করেছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ৩ মে থেকে কিছু কিছু ব্যাংকের দাম বাড়তে থাকে, যদিও দর বৃদ্ধির হার এত বেশি ছিল না।
পরদিন আরও আড়মোড়া ভাঙার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেদিন ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে দর বাড়ে ১৫টির, কমে ছয়টির। বাকিগুলো অপরিবর্তিত থাকে।
১৭ মে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ব্যাংক খাত দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। সেদিন ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে দর বাড়ে ২৭টির।
১৯ মে ঘটে আরও বিস্ময়কর ঘটনা। তালিকাভুক্ত সব কটি ব্যাংকের দর বাড়ে সেদিন।
বৃহস্পতিবার ব্যাংক খাতে লেনদেনের চিত্র
ব্যাংকের দর বৃদ্ধির এই সময়ে সবচেয়ে বেশি উত্থান হয়েছে এনআরবিসির। ২৭ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য ছিল ১১ টাকা ৬০ পয়সা। এরপর ৫ কার্যদিবস বেড়ে ৪ এপ্রিল দাম ছিল ১২ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে টানা বাড়তে বাড়তে তিন গুণ হয়েছে দাম।
আজ ব্যাংকের জোয়ারের দিন কেবল এই কোম্পানিটিই ৬০ পয়সা দর হারিয়েছে। সব শেষ দাম ৩৬ টাকা ৩০ পয়সা।
দাম বৃদ্ধির প্রান্তসীমা ছুঁয়েছে যেসব ব্যাংক
দিনের শুরুতেই এবি ও ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার হলট্রেড হয়ে যায়। আগের দিনও দিনের সর্বোচ্চ পরিমাণ বেড়ে ১৪ টাকা ৩০ পয়সা দাম ছিল। প্রথম লেনদেন হয় ১৫ টাকা ১০ পয়সা। মুহূর্তেই তা ১৫ টাকা ৭০ পয়সা উঠে যায়। একদিনে এর চেয়ে বেশি দাম বাড়া সম্ভব ছিল না। দাম উঠার পর আর নামেনি।
ওয়ান ব্যাংকের দাম মঙ্গলবার ছিল ১৩ টাকা ৩০ পয়সা। দাম বেড়ে উঠতে পারত সর্বোচ্চ ১৪ টাকা ৬০ পয়সা। লেনদেন শুরুই হয়েছে এই দরে। পরে ২০ পয়সা কমলেও আবার উঠে যায় এই সর্বোচ্চ দরে।
গত এক মাসে ওয়ান ব্যাংকের দাম বৃদ্ধির চিত্র
পরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, যমুনা, মার্কেন্টাইল, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের দামও দিন শেষে সর্বোচ্চ সীমা ছুয়ে যায়।
প্রান্তসীমা ছুঁয়ে কিছুটা কমেছে যেগুলোর দর
মঙ্গলবার ঢাকা ব্যাংকের দাম ছিল ১৫ টাকা ৫০ পয়সা। দিনে দাম বাড়ার প্রান্তসীমা ছিল ১৭ টাকা। এই দরে বিক্রি হয়েছে শেয়ার। পরে কিছুটা কমে দাম ক্লোজ জয় ১৬ টাকা ৭০ পয়সায়।
এ রকম আরও বেশ কিছু ব্যাংকের শেয়ার দর প্রান্তসীমা ছুঁয়ে পরে কিছুটা কমেছে।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শেয়ার দর ২২ টাকা থেকে ২৪ টাকা ২০ পয়সায় উঠে পরে কমে হয় ২৩ টাকা ৯০ পয়সা।
২৮ টাকা ৭০ পয়সা দাম থাকা রূপালী ব্যাংক সর্বোচ্চ বাড়তে পারত ৩১ টাকা ৫৯ পয়সা পর্যন্ত। এই পরিমাণ বেড়েও পরে ১০ পয়সা কমে দাম।
গত এক মাসে রূপালী ব্যাংকের দাম বৃদ্ধির চিত্র
একইভাবে ১৩ টাকা ৯০ পয়সা থেকে এসআইবিএলের দাম বেড়ে ১৫ টাকা ২০ পয়সা হয়। পরে ২০ পয়সা কমে ক্লোজ হয় ১৫ টাকায়।
পকেট গরম করেছে অন্য যেগুলো
এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের দাম বাড়া সম্ভব ছিল ৮ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত। ৮ টাকা ৭০ পয়সায় উঠে পরে ৮ টাকা ৬০ পয়সায় ক্লোজ হয়। দিন শেষে দর বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ।
এ ছাড়া ব্যাংক এশিয়ার ৬.৬৬, প্রিমিয়ারের ৬.২৯, পূবালীর ৬.১৭, এনসিসির ৫.১৭ শতাংশ, শাহজালালের ৫.৯২, ইসলামীর ৪.১৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার কমলেও এক মাসে এনআরবিসির দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে
কমেছে কেবল এনআরবিসির দাম। গত ২৭ এপ্রিল থেকে টানা বেড়ে মঙ্গলবার ব্যাংকটির শেয়ার মূল্য দাঁড়ায় ৩৬ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে ৬০ পয়সা কমে দিন শেষে দাম দাঁড়িয়েছে ৩৬ টাকা ৩০ পয়সা। যদিও এক পর্যায়ে দাম হয়ে গিয়েছিল ৪০ টাকা।
‘লভ্যাংশের তুলনায় দাম এখনও কম’
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে গঠিত ব্র্যাক ইপিএলের গবেষণা শাখার সাবেক প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার মনে করেন, ব্যাংকগুলো এ বছর যে হারে লভ্যাংশ দিয়েছে তার তুলনায় শেয়ার দর এখনও কম।
গত এক মাসে ঢাকা ব্যাংকের দর বৃদ্ধির চিত্র
তিনি বলেন, `ব্যাংকের শেয়ারের উত্থানে আতঙ্কের কিছু নেই। আর শুধু যে ব্যাংকের শেয়ারের দর বেড়েছে তা কিন্তু নয়। অন্যান্য খাতেরও শেয়ারের দর বেড়েছে। এটাই পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক দিক।’
ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী শহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকের শেয়ার দর দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত অবস্থায় ছিল। এখন সেগুলোর দাম বাড়ছে। আর সম্প্রতি ব্যাংকগুলো তাদের শেয়ারধারীদের জন্য যে পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার তুলনায় শেয়ার দর এখনও কম। এজন্য এখানে নতুন বিনিয়োগ হতে পারে। ব্যাংকের শেয়ার দর যে অবস্থা আছে তা থেকে আরও বাড়া উচিত।’
গত এক মাসে প্রাইম ব্যাংকের দর বৃদ্ধির চিত্র
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারের জন্য ভালো হচ্ছে যে সব কোম্পানির তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা রাখে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে। বিনিয়োগকারীদের সেসব কোম্পানির প্রতিই আগ্রহী হওয়া উচিত।’