বাংলাদেশের তরুণ ইমরান রহমানের কাছে ২০১১ সালে ১১টি বিটকয়েন ছিল যিনি ভিডিও দেখে খরচ করেছেন। এখন তার আফসোসের সীমা নেই।
কারণ, এখন একেকটি কয়েনের দাম ৫২ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ৪৪ লাখ টাকার বেশি। সেই ১১টি কয়েনের দাম এখন ৫ কোটি টাকা হতো।
তবে আফসোস না করে ইমরান নিজেকে প্রবোধ দিতে পারেন এই ভেবে যে, এই ভার্চুয়াল মুদ্রার হাতবদল বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। যদি তিনি বিক্রি করতে যেতেন, তাহলে আইনি ঝামেলায় পড়তে হতো।
এ অবাক করা এক বিনিময় মুদ্রা, যার কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। কাজ হয় না সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে। ডিজিটাল ক্যাশ সিস্টেমে যা পরিচালনা করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক।
ডিজিটাল এই মুদ্রার মালিকানা অনলাইনে বিনিময় হয় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে। তবে কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, এই মুদ্রা কেনাবেচা করা যাবে না।
এর পরেও বন্ধ নেই এর কারবার আর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে একে ওকে গ্রেপ্তারের খবর।
বাংলাদেশ মনে করছে এই ভার্চুয়াল মুদ্রা দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মাদক লেনদেন বা অর্থ পাচারে এই মুদ্রা ব্যবহার হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখনো সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও আমরা এ ধরনের মুদ্রার অনুমতি দিচ্ছি না।’
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ বা এবিবির সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্রিপ্টো-কারেন্সি বা বিটকয়েনের উপরে এখনও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ননলিগ্যাল টেন্ডার মানি। এ দেশে অধিকাংশ মানুষ ক্যাশে পেমেন্ট করতে আগ্রহী। আর বিটকয়েনে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়। এজন্য আপাতত এ ধরনের কারেন্সি অনুমোদনের সময় এখনও আসেনি’।
বিটকয়েন কী
বিটকয়েন হলো এক ধরনের অনলাইন মুদ্রা বা জিডিটাল কারেন্সি। ২০০৯ সালে এটি উদ্বোধন করেন উদ্ভাবক সাতোসি নাকামোতো (ছদ্মনাম)। তবে অস্ট্রিলীয় নাগরিক ক্রেগ রাইটসও নিজেকে বিটকয়েনের উদ্ভাবক বলে দাবি করেন।
বলা হচ্ছে, এই মুদ্রার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। একজনের ব্যক্তিগত ওয়ালেট থেকে আরেকজনের ওয়ালেটে লেনদেন হয়। এই ওয়ালেট হলো ব্যক্তিগত ডেটাবেজ যা কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ক্লাউড যাতে তথ্য সঞ্চিত থাকে। বিটকয়েন ব্যবস্থা এতটাই গোপনীয় যে ব্যবহারকারীরাও নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারেন। এই কারণে যারা তথ্য গোপন রাখতে চান, তাদের মধ্যে বিটকয়েন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিটকয়েন তৈরি বা কেনার পর তা গ্রাহকের হিসাবে জমা থাকে। পরে তিনি সেগুলো ব্যবহার করে পণ্য কিনতে পারেন বা বিক্রি করে দিতে পারেন। বিভিন্ন দেশে বিক্রি করলে বিটকয়েনের পরিবর্তে প্রচলিত অর্থও গ্রহণ করা যায়। বিভিন্ন কম্পিউটার ব্যবহার করে লেনদেন করা হলেও সেসব তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে হালনাগাদ করা হয়ে থাকে।
বিশ্বে এই মুদ্রার সংখ্যা এখন ৯ কোটির বেশি। প্রতিদিন যার মাধ্যমে ৫ কোটি ডলারের লেনদেন হচ্ছে ব্যাংক থেকে শুরু করে অনলাইন বেচাকেনায়। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ধনকুবের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে অর্থ গোপন করার প্রবণতা। বিটকয়েনের অর্থ গোপনীয়তায় দেবে পূর্ণ নিশ্চয়তা।
বাংলাদেশের কী সিদ্ধান্ত
২০১৪ সালে বিটকয়েন লেনদেনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক এই সংস্থা বলছে, ‘এসব মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয় বিধায় এসব ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭; সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর দ্বারা সমর্থিত হয় না।’
২০১৭ সালে এই লেনদেনকে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়, ‘নামবিহীন বা ছদ্মনামে প্রতিসঙ্গীর সঙ্গে অনলাইনে ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের দ্বারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।’
এ ছাড়া, অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লেনদেনকারী গ্রাহকরা ভার্চুয়াল মুদ্রার সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন বলে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যবহার থেমে নেই
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা এবং নানান নেতিবাচক উদাহরণ সামনে এলেও বাংলাদেশে বিটকয়েনের ব্যবহার থেমে নেই। তবে, ঠিক কত মানুষ এই লেনদেনে রয়েছেন তার সঠিক কোনো তথ্য কোনো সংস্থার বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা জুয়া, হুন্ডি, চোরাচালান, সাইবার চাঁদাবাজিতে ব্যবহার হচ্ছে এসব ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে এসব মুদ্রা লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
তবে আউটসোর্সিং পেশার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, আউটসোর্সিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক প্রতিষ্ঠানই বিটকয়েন লেনদেন করে। আইনগতভাবে নিষিদ্ধ থাকায়, অনেকেই এই লেনদেনে থাকলেও প্রকাশ করে না।
বাংলাদেশে কি অপরিহার্য?
এবিবির সাবেক প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, মানুষ এখনও এই মুদ্রা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। ফলে তারা প্রতারিত হতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘এটা কীভাবে মুভমেন্ট হচ্ছে, কীভাবে লেনদেন চলছে সেটার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটার ব্যবসা এখন যেভাবে হচ্ছে, কেউ কিনে রেখে দিচ্ছেন, দাম বাড়লে আবার বিক্রি করছেন। আজ ১ ডলার দিয়ে কিনলে কাল সেটা ১০০ ডলার হয়ে যেতে পারে। ভালোভাবে না বোঝার কারণে এখানেও কিন্তু প্রতারণার একটা সুযোগ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটার মাধ্যমে টাকা পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এটা মানি লন্ডারিংয়ে সাহায্য করবে। এটা অনুমোদনের ধারেকাছেও আমরা নেই। এজন্য এটা বৈধতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না।’
ক্রিপ্টোকারেন্সির পক্ষে না হলেও তিনি ডিজিটাল মুদ্রার পক্ষে মত দেন।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ। এর মধ্যে একজনেরই তিন থেকে চারটা কার্ড আছে। এমন হিসাব করলে ক্রেডিট কার্ড ৫ থেকে ৬ লাখ হবে। এখনও আমাদের দেশে কার্ডে লেনদেন কম। সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু হলে সমস্যা বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘পাশ্ববর্তী দেশেও এখনো এটা নিষিদ্ধ। এখনও অনেক মানুষ চেকই ব্যবহার করতে শেখেননি, সেখানে এ ধরনের কারেন্সি কীভাবে চলবে। ডিজিটাল মানি অবশ্যই চালু হবে কিন্তু তার আগে অর্থনীতিকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে।’
এখনও এই লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ মুদ্রা আছে। পরবর্তীকালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপাতত এ ধরনের মুদ্রা অনুমোদনের কোনো পরিকল্পনা নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিটকয়েনের কোনো অনুমোদন নেই। তাই এর লেনদেন অবৈধ। আমাদের নোটিশে যদি এই জাতীয় লেনদেনের খবর আসে, তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’