টানা ১৪ কার্যদিবসে দরপতন হলো ১৩ টাকা ৪০ পয়সা। আর দুই দিনেই দাম বাড়ল ছয় টাকা ৬০ পয়সা।
ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর প্রতিদিনই খুলনা পাওয়ার কোম্পানি বা কেপিসিএল দর হারিয়েছে একদিনে যত কমা সম্ভব ততই। তবে প্রথম দিন ১০ শতাংশ কমার পরে দ্বিতীয় কার্যদিবস কমতে পেরেছে সর্বোচ্চ দুই শতাংশ।
আবার বৃহস্পতিবার থেকে দুই দিনই সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের কাছাকাছি দাম বাড়ে।
কারণ, বিএসইসির নির্দেশনা। বিএসইসি জানিয়েছে, যেসব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেগুলো সর্বোচ্চ দুই শতাংশ কমতে পারলেও সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়া যাবে।
কেপিসিএল নিয়ে আগ্রহ হারানোর পর আবার ফিরে আসার কারণ অনুমোদন শেষ হতে যাওয়া দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়িয়ে দিতে বিএসইসির সুপারিশ।
কোম্পানিটির বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মোট তিনটি। এর মধ্যে একটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে ২০১৮ সালেই। আর দুটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছর।
এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কেবল সহযোগী ইউনাইটেড পায়রা প্লান্টের ৩৫ শতাংশের মালিকানা থেকে যে আয় আসবে তা থেকেই লভ্যাংশ দিতে হবে শেয়ারধারীদের।
টানা দাম কমার কারণ এটি।
এ নিয়ে শেয়ারধারীরা উদ্বিগ্ন থাকলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হচ্ছিল না।
এই অবস্থায় গত ২৩ মার্চ বিএসইসি কার্যালয়ে ডাকা হয় কেপিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। তারা বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এর সঙ্গে বৈঠক করেন । তবে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি কোনো পক্ষই।
তবে আগ্রহ হারানো কোম্পানিকে ঘিরে আগ্রহ বাড়ার কারণ, গত ১৫ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানকে বিএসইসির চিঠি। দুটি কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়াতে কেপিসিএল যে আবেদন করেছে, সেদি কিববেচনার জন্য অনুরোধ করেছে বিএসইসি।
যেখানে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার কোম্পানিসমূহ পুঁজিবাজার থেকে বিভিন্ন সময় মূলধন সংগ্রহের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
এ পরিস্থিতিতে খুলনা পাওয়ার কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অর্থ লভ্যাংশ থেকে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ফেরত আসেনি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এ কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কমিশন উদ্বিগ্ন। তাই কেপিসিএলসহ অন্যান্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির পিপিএ চুক্তি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নবায়নের সুযোগ রয়েছে কি না, তা জানানোর জন্য অনুরোধ করেছে কমিশন।
আশ্বাস মেলেনি
চিঠির অগ্রগতি সম্পর্কে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চিঠি পাঠিয়েছি কিন্ত এখনও এর কোনো অগ্রগতির খবর আসেনি। এটি হয়ত অনেক কাজ আছে। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যাবে। ফলে সময় প্রয়োজন। তবে আমরা আশা করি সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।’
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০০৯ সালের পর বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় নির্মিত কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুমোদন বার বাড়াবে না। এই অবস্থায় কেপিসিএলের অনুমোদন বাড়বে কি না-এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিএসইসি কমিশনার বলেন, ‘সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত। নতুন করে কুইক রেন্টাল অনুমোদন দেয়ার পক্ষে আমিও না। তবে যেসব কুইক রেন্টাল অনুমোদন দেয়া হয়েছে তারা আরও ২০ বছর পরিচালনা করতে পারবে। সে সুযোগ তাদের দেয়া উচিত।’
অনুমোদন না দিলে কোম্পানিটি টিকে থাকতে পারবে কি না প্রশ্নে শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অনুমোদন না দিলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের আয় কমে আসবে। ফলে আগে যেভাবে টিকে ছিল সেটির অবশ্যই ব্যত্যয় হবে।’
বাড়ছে শেয়ার দর
কেপিসিএলের দুই কেন্দ্রের শেয়াদ বাড়বে কি না, এমন কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি সরকারের তরফ থেকে। তবে বিএসইসির চিঠির খবরেই শেয়ার দর বাড়ছে।
বিএসইসির চিঠির খবর ফাঁস হওয়ার আগে ২৭ এপ্রিল কেপিসিএলের দর ছিল ৩১ টাকা ৯০ পয়সা। তবে ২৮ এপ্রিল শেয়ার দর বেড়ে হয় ৩৫ টাকা।
দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার হঠাৎ করেই তুমুল আগ্রহের শেয়ারে রূপান্তর হয় এই কেপিসিএল। শেয়ার দর দিনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বেড়ে হয় ৩৮ টাকা ৫০ পয়সা। এক পর্যায়ে বিক্রেতাশূন্য হয়ে যায় কোম্পানিটি।
তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য
খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের হাতে ছিল তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে একটির মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হওয়ায় আর নবায়ন করা হয়নি।
বাকি দুটির মধ্যে খানজাহান আলী পাওয়ার লিমিটেডের ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ মে। আর খুলনা পাওয়ার কোম্পানি ইউনিট টু ১১৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ২৮ মে।
কেপিসিএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পায়রা প্লান্ট
এই দুটি বন্ধ হয়ে গেলে কেপিসিএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পায়রা প্লান্টই বিনিয়োগকারীদের একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে থাকবে।
গত ২১ জানুয়ারি ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
পটুয়াখালীর খোলিশখালীতে অবস্থিত এই কেন্দ্র থেকে ১৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এখানে কেপিসিএলের মালিকানা ৩৫ শতাংশ।
শেয়ার নিয়ে হতাশা
২০১০ সালে চাঙা পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি হয় গড়ে ১৯৪ টাকা করে। ছয় বছর বোনাস শেয়ার দিয়ে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩৯৭ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার।
চলতি বছরের জানুয়ারি ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ বা ১ কোটি ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগাকরীরা। যার পুরোটা কিনেছে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা।
ফলে এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির মোট শেয়ারের ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ আর ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ফলে বর্তমানে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর নবায়ন না হয়, তাহলে এরা সবাই অনিশ্চয়তায় পড়বেন।
লভ্যাংশের পরিসংখ্যান
কোম্পানিটি ২০১০ সালের। তালিকাভুক্তির বছরে ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করে।
এরপর ২০১০ সালের জন্য ২০ শতাংশ, ২০১১ সালের জন্য ২৫ শতাংশ, ২০১২ সালের জন্য ১২.৫ শতাংশ, ২০১৩ সালের জন্য ৫ শতাংশ এবং ২০১৮ সালের জন্য আবার ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করা হয়।
১৯৪ টাকা ভিত্তি ধরে ১০ বছরের বোনাস শেয়ার হিসাব করলে দাম দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৫৫ পয়সা।
পাঁচ বছর ধরে নগদ লভ্যাংশের দিকে জোর দেন কোম্পানির উদ্যোক্তারা। ২০১৬ সালে ৭৫ শতাংশ (শেয়ারপ্রতি সাড়ে সাত টাকা), ২০১৭ সালে ৫৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০২০ সাল ৩৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কেপিসিএল।