করোনার প্রথম আঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এসেছে দ্বিতীয় ঢেউ। এতে চলতি অর্থ বছরে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা, অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, পিছিয়ে পড় রাজস্ব আদায় ও উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় করোনাকালীন নতুন বাজেটে বুঝে শুনে পদক্ষেপ নেয়ার প্রত্যাশা করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি।
এর মধ্যে আয় বাড়াতে আগামী অর্থবছরের (২০২২-২২) জাতীয় বাজেটে ধনীদের আয়কার বাড়ানোর এবং ব্যবসায়ীদের সমান সুযোগ দিতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে সিপিডি।
নতুন বাজেটে করোনা চিকিৎসায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো; কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং কৃষি, এসএমই ও রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এসব পরামর্শ তুলে ধরে সিপিডি।
কর বিষয়ক প্রস্তাব
মূল প্রবন্ধে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম বলেন, ‘ব্যক্তিখাতের করের হার সর্বোচ্চ হার বা ধনীদের আয়কর গত বছর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। সেটি আবার ৩০ শতাংশ ফিরিয়ে নেয়া উচিত।’
বিভিন্ন দেশ এখন এটা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যাদের বেশি আছে তাদের থেকে সংগ্রহ করে প্রান্তিক পর্যায়ে দিতে হবে।’
যারা টিআইএন নিয়েছেন তাদের কর প্রদানে তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি নতুন করদাতাও বের করা। অর্থপাচার ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল সেটা বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শও দেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো।
পরে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখন প্রবৃদ্ধিটা সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। এখন নতুনভাবে মেগা প্রকল্পে না গিয়ে, কীভাবে কর্মসংস্থান বাড়ে সেসব প্রকল্পে মনোযোগ দিতে হবে। সেগুলোতে অভর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’
বাজেট ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ওপর জোর দেয়ার দাবি জানিয়ে রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ব্যাংক খাতে বড় পরিমাণে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। আমরা অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা বলছি, সে ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি যদি বেশি হয়, তাহলে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ না করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ এখন বেসরকারি খাতে চাহিদা কম।’
কর কমিয়ে ইন্টারনেট আরও সহজলভ্য করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট এখন শুধু ধনীরা ব্যবহার করে না। অনেক সাধারণ মানুষকে শিক্ষার কাজে, ব্যবসা বা অন্য কাজে কাজে এটি ব্যবহার করতে হচ্ছে। যে ধরনের কর কাঠামো এখানে আছে তা এ খাতের জন্য সহায়ক নয়। এজন্য এ খাতের ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১ শতাংশ সোর্স ট্যাক্স তুলে দিতে হবে।’
বাজের ঘাটতি মোকাবিলয়ায় বিদেশি অর্থায়নে জোর দেয়ারও তাগিদ দেন বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ান
সিপিডির রিসার্চ ফেলো বলেন, ‘এই মুহূর্তে সব থেকে খারাপ পারফর্ম করা একটা বিভাগ হলো স্বাস্থ্য বিভাগ। এটা দুঃখজনক। কিন্তু এ সময় তাদের সবচেয়ে বেশি কাজ করার কথা ছিল। স্বাস্থ্য খাতে যে ধরনের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনর অনিয়ম, দুর্নীতি, বেশি দামে পণ্য কেনার খবরগুলোও দুঃখজনক।
‘তবু যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে, যেন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা না হয়। যত দ্রুত সম্ভব বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে।’
স্বাস্ব্য খাত নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ধরনের বাজেট বরাদ্দ দরকার তার ক্ষেত্রে সরকার যেন কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ না করে। নতুন ইউনিট স্থাপন, আইসিইউ স্থাপন, অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে।’
স্বাস্থ্যসেবা পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফ করা, খাদ্য এবং করোনা চিকিসায় ব্যবহৃত ওষুধ ও কাঁচামাল আমদানিতে কর পরিহার করার পরামর্শও দেয়া হয় মূল প্রবন্ধে।
বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখন স্বাস্থ্য খাতকে আমাদের অগ্রাধিকার দিয়ে, যে ঝুঁকিগুলো নতুন হচ্ছে এটাকে কীভাবে সামাল দেবে, সেটা বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের নিচেই রয়েছে। এটা বাড়ছে না। এটা কমপক্ষে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ করা উচিত।’
কালোটাকা সাদা করতে না দেয়ার পরামর্শ
ব্যবসায়ীদের জন্য গত বছর যে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে তা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেয়া হয় মূল প্রবন্ধে। তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া বন্ধ করার পরামর্শ দেয়া হয় এতে।
পরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘চলতি অর্থ বছরে এ খাত থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। যেটা খুব বড় অংক বলে মনে হয় না। বরং আমরা মনে করি যারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাদেরকে নিরুৎসাহিত করছে।’
সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ নিয়ে ভাবনা
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কারা পাচ্ছে, সেটি নিয়ে তদারকির আহ্বানও জানান মোস্তাফিজুর রহমান। বলেন, ‘বর্তমানে বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি একাধিকবার পাচ্ছেন। আবার কোনো কোনটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য। কিন্তু এ মুহূর্তে সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে।’
করোনাকালে নেয়া কর্মসূচিগুলো দুই বছর চালু রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বছরে অন্তত দুই থেকে তিনবার কমপক্ষে দুই হাজার করে টাকা দেয়া যেতে পারে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত বছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনসহ কিছু বিষয় যোগ করা হয়। ফলে প্রকৃত অর্থে তা বাড়েনি। তবু সব মিলিয়ে এখাতে জিডিপির ২ শতাংশশের মতো বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু আমরা বলছি তা কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ শতাংশ হওয়া উচিত। ’