মহামারির ধাক্কা লেগেছে রপ্তানি খাতের প্রায় সব সেক্টরে। যেখানে তৈরি পোশাক, চামড়া, হিমায়িত মাছসহ সব খাতেই রপ্তানি আয় কমছে, সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম পাট।
জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও ৮ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। আর আগের অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে তা ২৩ শতাংশ বেশি।
এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৩০ কোটি (১.৩ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে বলে প্রত্যাশা করছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মঙ্গলবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৯৫ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার আয় করেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার করেছিল বাংলাদেশ।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ আয় করার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। জুলাই-মার্চ সময়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৮৬ কোটি ১৮ লাখ ডলার। সেই লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
গত অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ১২ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম।
এই ৯ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৩৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। তা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং লক্ষ্যের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম।
চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৬৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। এই সময়ে হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে পাট সুতা (জুট ইয়ার্ন) রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৭ লাখ ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ০৯ শতাংশ। কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৭০ হাজার ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
এ ছাড়া এই ৯ মাসে পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৬ কোটি ১২ লাখ ১০ হাজার ডলারের।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় টাকার অঙ্কে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, যদিও পরিমাণে খুব একটা বাড়েনি। তবে আমরা আশাবাদী, পাট আমাদের জন্য আরও সুখবর বয়ে আনবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল প্যাকেট বা বস্তাবন্দি করতে পাটের থলে লাগবে। অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এরই মধ্যে ভালো অর্ডার পেতে শুরু করেছি আমরা। রপ্তানিও করছি।’
পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনায় এমনিতেই পলিথিন ব্যবহার কমে আসছিল বেশির ভাগ দেশে। কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে লকডাউনে দূষণ কমে আসার বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে।
এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, পরিবেশের বিষয়টি সামনে আরও জোরালোভাবে সামনে আসবে। আর তাতে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে।’
বস্তা বা ব্যাগের পাশাপাশি কার্পেটের জন্যও বাংলাদেশের পাটের চাহিদা বাড়তে পারে জানিয়ে সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন, ‘কার্পেট তৈরিতে আমাদের জুট ইয়ার্ন ব্যবহৃত হয়। কোভিড-১৯ আতঙ্কে অনেকেই বাসা বা অফিসের কার্পেট পরিবর্তন করবেন। তখন আমাদের পাটের কদর বাড়বে।’
বিশ্বব্যাপী পলিথিনের ব্যবহার কমায় পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে বলে জানান সাজ্জাদ হোসাইন।
‘ভবিষ্যতে চাহিদা আরও বাড়বে। আমরা আমাদের “সোনালী আঁশ” পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি, যদি এ খাতের দিকে একটু নজর দিই। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ছাড়া আর মাত্র একটি-দুটি দেশে পাট উৎপন্ন হয়। বিশ্ব যত বদলাবে পাটপণ্যের চাহিদা ততই বাড়বে। পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশগুলো এ পথে অগ্রসর হবে।’
এ বিষয়ে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে; এই মহামারির মধ্যেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।
‘তবে আমাদের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কাঁচা পাটের দাম খুবই চড়া। এবার ভরা মৌসুমেও প্রতি মণ পাটের দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা ছিল। এখন পাঁচ হাজার টাকার বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি দামে কখনই পাট বিক্রি হয়নি।
‘চড়া চামে পাট কিনে পাটপণ্য রপ্তানি করে বাজার ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সে কারণেই আমরা সরকারের কাছে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি।’
পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে কয়েক বছর ধরেই খারাপ সময় যাচ্ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে ৮১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি করে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রা আয় করেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারই এ খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৯৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। তার আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল ৯২ কোটি ডলার।