চার বছরের বেশি সময় ধরে চলছে বাংলাদেশ-ভারতের পাটযুদ্ধ। বাংলাদেশের পাট শিল্পের অগ্রগতির জন্য শিগগিরই এ যুদ্ধের অবসান আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দুই দেশের পাটযুদ্ধের সন্তোষজনক নিষ্পত্তির আশা করছেন তারা।
বাংলাদেশের প্রতি টন পাটসুতা, চট ও বস্তা রপ্তানির ওপর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ভারতের রাজস্ব বিভাগ ১৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে গেজেট প্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ। এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাময় পাট খাত।
দীর্ঘ এ সময়ে বাংলাদেশ দফায় দফায় পাটযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারতের প্রতি আবেদন জানিয়েছে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অনেকবার আলোচনা ও চিঠি চালাচালি হয়েছে। তাতে আশ্বাসও মিলেছে। শেষ পর্যন্ত ফল মেলেনি।
পাটযুদ্ধ শুরুর আগে ভারতে ব্যাটারিযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৪ সালে গাড়ির ব্যাটারি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল ভারত।
সংক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আপিল ট্রাইব্যুনালে যায়। ভারতও সেখানে সমানতালে লড়ে। তবে এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারতকে হটিয়ে বাংলাদেশই বিজয় ছিনিয়ে আনে।
শিগগিরই পাটযুদ্ধেরও সমাপ্তি চায় বাংলাদেশ। তবে এবার ব্যাটারির মতো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার জন্য এখনও ডব্লিউটিওর আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়া হয়নি। যদিও সেখানে যাওয়ার মতো সব ধরনের প্রস্তুতি বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশ চায় উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়টির শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি।
কারণ যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি পাটে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসিয়েছে ভারত, তা যথাযথ হয়নি। বাংলাদেশ আশা করছে, ভারত তার সিদ্ধান্ত সংশোধন করবে এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
পাটে অ্যান্টি ডাম্পিংয়ে এই যখন পরিস্থিতি, তখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে ভারতের জন্যও সময়টি ঐতিহাসিক। এ উপলক্ষে আজ দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এ সফরকে ঘিরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে যাওয়ার প্রত্যাশার কথা বলেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে আগাম আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে বাংলাদেশে আসা ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পসচিব অনুপ ধাওয়ানের সঙ্গে বৈঠকে তিনি দাবি করেন, যেসব পণ্যের ওপর ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং আরোপ করা আছে, আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর যৌক্তিক সমাধান হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে দুই দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে এমন কিছু করতে, যা উভয় দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
তার বক্তব্যে আশ্বস্ত হন পাট খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা আশা করছেন, নরেন্দ্র মোদি এবারের বাংলাদেশ সফরে পাটযুদ্ধ পরিসমাপ্তির একটা সবুজ সংকেত দেবেন। সরকারে বিভিন্ন স্তরের বক্তব্যেও পাটে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে বলে অনেকে আশায় বুক বেঁধেছেন।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন মহল জানায়, সফরে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও অমীমাংসিত অনেক বিষয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি বাণিজ্যসহ নানা বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। তবে সেখানে ভারত পাটে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক তুলে নেয়ার মতো কোনো সবুজ সংকেত থাকবে না। অর্থাৎ পাট ইস্যুতে নমনীয়তার বিষয়ে ভারতের আগের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসছে না। ফলে দুই দেশের পাটযুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে বাণিজ্য বৃদ্ধিকরণ সংক্রান্ত বেশ কিছু ইস্যুতে আলোচনা হবে। এর মধ্যে নতুন আরও কয়েকটি বর্ডার হাট স্থাপনের সিদ্ধান্ত অন্যতম। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য উন্নয়ন ও বিদ্যমান বাধা দূর করা সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি সই হবে।
সরকারপ্রধানদের নির্দেশ অনুযায়ী আগামীতে এ চুক্তির আওতায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুলবে। সেখানে বাংলাদেশি পাটে ভারতের আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার ইস্যুতেও আলোচনার সুযোগ থাকবে।
গুণ-মান ভালো ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে ভারতের বাজারে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি হতো। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সাফটার আওতায় বাংলাদেশ ভারতে শূন্য শুল্কে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে।
কিন্তু হঠাৎ করেই ভারত সাফটা চুক্তিকে অকার্যকর করে পাট রপ্তানি কমাতে বাংলাদেশি পাট ও পাট পণ্যে সেই শূন্য অবস্থা থেকে প্রতি টনে সর্বোচ্চ ৩৫১ দশমিক ৭২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক ধার্য করে দেয়।
এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিযোগ ছিল, তাদের স্থানীয় বাজারের চেয়ে কম দামে পাট রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। সমজাতীয় পণ্য কোনো রপ্তানিকারক দেশ আমদানিকারক দেশের স্থানীয় বাজারের তুলনায় কম মূল্যে রপ্তানি করলে সেখানে ডাম্পিং হয়েছে বলে ধরা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত স্থানীয় সমজাতীয় পণ্য খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দেশ যে প্রতিরক্ষণমূলক শুল্ক ব্যবস্থা নেয় সেটাই হলো-অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক।
তবে এর সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯১ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে, যার ২০ শতাংশ গেছে ভারতে।
ইপিবির এই তথ্যের সূত্র টেনে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানিকারকরা দাবি করছেন, যে বছর অ্যান্টি ডাম্পিং পদক্ষেপ নেয় ভারত, ওই বছর বাংলাদেশ যে পরিমাণ পাট রপ্তানি করেছে তা ভারতীয় বাজারের ৮ শতাংশ, যা ভারতের যুক্তিকে যৌক্তিক প্রমাণ করে না।
তারা আরও দাবি করেন, নিয়ম হলো অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে, যেটা ভারত করেনি।
ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি) অধিদপ্তর ২০১৬ সালের অক্টোবরে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের সুপারিশে বাংলাদেশি উৎপাদকরা পাট রপ্তানিতে যে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাচ্ছেন সেই বিষয়টিকেও বড় করে দেখেছেন।
বাংলাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবারের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য জট খোলার একটি পথ তৈরি হবে। তবে পাটে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত এখনই হবে না। কারণ ভারত এ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে আরও পরিষ্কার হতে চায়। আরও সময় নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে চায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি মাসে প্রথম দিকে দুই দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হলে জবাবে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশকে নতুন করে প্রস্তাব দিতে। আমরা এখন সেদিকেই যাচ্ছি।’
চার বছর পার হয়ে গেছে, কোনো সমাধান আসছে না। বাংলাদেশ সংক্ষুব্ধ হয়ে ডব্লিউটিওতে যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডব্লিউটিও সেলের এই মহাপরিচালক বলেন, ‘যাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তার আগে আমরা দুই দেশের মধ্যকার আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই। দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই বিষয়টির সমাধান আশা করছে বাংলাদেশ।’
কোয়ালিটি জুট ইয়ার্ন মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মালেক এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা প্রত্যাহারে সরকার ভারতের সঙ্গে নিবিড় চেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বশেষ আশ্বাস মিলেছিল, এ বছরই একটা সিদ্ধান্ত আসবে। ফলে আমরাও আশা করেছিলাম, হয়তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরে এর একটা সুরাহা হবে। সেটি না হলে সৃষ্ট জটিলতা আরও দীর্ঘসূত্রতায় গড়াবে।’
বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও শ্যামল বাংলা জুটেক্স লিমিটেডের কর্ণধার লুৎফর রহমান বলেন, ‘যেকোনো দেশের জন্যই অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বাণিজ্য সম্পসারণে বড় বাধা। ভারত আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় তাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বেশি। আবার বাণিজ্য ব্যবধানও বেশি, যা ভারতের অনুকূলে।’
‘বাণিজ্য পরিবেশ থাকলে দুই দেশের জন্যই টেকসই বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়ক হবে। আমরা আশা করব বিবাদমান এ সমস্যা শিগগির দূর হবে।’