পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার সীমা ৩৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠিয়েছে।
এতে বলা হয়, প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য খরচ বাদে যেসব ব্যাংক ১৫ শতাংশ বা তার বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে সেসব ব্যাংক তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদসহ মোট ৩৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
গত ডিসেম্বরে খবর আসে করোনার মধ্যেও ২০২০ সালে ভালো মুনাফা করেছে ব্যাংকগুলো। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো এ বছর বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে।
এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলোর জন্য গত ৭ ফেব্রুয়ারিতে লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দিয়ে নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। তবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া যাবে।
এমন সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এরপর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থবছর শেষ হয় ডিসেম্বরে। এ সময়টিতে মূলত এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে থাকে।
লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক বিনিয়োগকারীরাসহ বাজার বিশ্লেষকরা। এ অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন তারা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ঘোষণায় সীমা বেঁধে দেয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে দাবি ওঠে সব মহল থেকে।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকদের সমিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই নির্দেশনা পাল্টাতে চিঠি দেয়। চিঠি দেয় ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ।
বিষয়টি পর্যালোচনা চেয়ে আসছিল বিএসইসিও। পুঁজিবাজার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করে অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যবস্থা নেবে, এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০১৫ সালেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়টি মেনে চলেনি আর।
সমালোচনার মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ঘোষণার বিষয়ে নির্দেশনা থেকে সরে আসার আসার ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রেক্ষিতে সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে বিএসইসির সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এর নেতৃত্বে কমিশনের মুখপাত্র ও কমিশনাররা অংশ নেন।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণার সুযোগ থাকলেও এর মধ্যে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ নগদে এবং কী পরিমাণ বোনাস শেয়ার দেয়া যাবে, সেই বিষয়টি পরে জানানো হবে বলে জানানো হয়। পাশাপাশি ব্যালান্স শিটের বিবেচনায় কোন ব্যাংক কত পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে, সেটিও নতুন ঘোষণায় থাকবে বলে জানানো হয়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আসছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিএসইসি। ছবি: নিউজবাংলা
ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নগদের পাশাপাশি বোনাস শেয়ারও দিতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান যতই আয় করুক, তারা ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ শেয়ার প্রতি দেড় টাকার বেশি লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে না।
আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি হলে তারা কোনো লভ্যাংশই বিতরণ করতে পারত না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারত।
যদিও এই ঘোষণা দেয়ার আগেই একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ শতাংশ (শেয়ার প্রতি সাড়ে তিন টাকা) নগদ, দুটি প্রতিষ্ঠান ১২ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ার প্রতি এক টাকা ২০ পয়সা এবং একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার প্রতি ৬০ পয়সা নগদের পাশাপাশি ৬ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণের প্রস্তাব করেছে।
ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যে বোনাস শেয়ার ঘোষণার ক্ষমতা পাচ্ছে, তার পরিধি কত হবে সেটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে স্পষ্ট করা হবে বলে জানানো হয় বৈঠকে।
এর বাইরে লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংক্রান্ত যে জটিলতা রয়েছে তাও নিরসন করা হবে।
নগদে লভ্যাংশ বিতরণে উৎসাহিত করতে সরকার গত কয়েক বছর ধরে কেবল বোনাস শেয়ার ইস্যু করলে বাড়তি করারোপ করছে।
৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা নির্দেশনায় সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদসহ মোট ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অবশ্য কোনো ক্ষেত্রেই ডেফারেল (প্রভিশন সংরক্ষণে অতিরিক্ত সময়) সুবিধা নেয়া যাবে না।
আগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, যেসব ব্যাংক কমপক্ষে সাড়ে ১৩ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে সেসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশ নগদসহ মোট ২৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
যেসব ব্যাংক অন্যান্য খরচ মেটানোর পর সাড়ে ১২ শতাংশ বা তার বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে সেসব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ নগদসহ মোট ১২ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে যেসব ব্যাংকের মূলধন ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১১ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত হয় সেসব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নগদসহ মোট ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সেসব ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ১০ দশমিক ৬২৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ হয় সেসব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
তবে নতুন জারি করা প্রজ্ঞাপনে এসব বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।