পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের হিসাব গণনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। বাজারমূল্য নয়, এর বদলে ক্রয়মূল্যের হিসাবেই ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার নির্ধারণ হবে।
এর ফলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের বাধা কাটবে বলে আশা করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ ও দেবব্রত কুমার সরকার।
তারা বলছেন, এখন কম শেয়ারের দাম বাড়লে ব্যাংকগুলোকে আর বাধ্যতামূলকভাবে তা বিক্রি করতে হবে না।
সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনার হিসাব পালটানোর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ‘মিউচ্যুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকের বিনিয়োগ-সংক্রান্ত এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপ্রোজার গণনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বিএসইসিকে আশ্বস্ত করেছেন।’
এই বিষয়টির পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সীমা বাড়ানোর বিষয়টি পরে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করবে বলেও জানানো হয়েছে।
একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে ২০১৪ সালে করা নীতিমালায় বাজারমূল্যে বিনিয়োগসীমা গণনা হওয়ায় ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারে না।
এই এক্সপোজারের হিসাব গণনার নীতি পালটাতে গত কয়েক বছর ধরেই পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি হচ্ছিল না।
বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কম এবং এটাকে বাজারের স্থিতিশীলতার একটি অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারদর হঠাৎ পড়ে গেলেই বিক্রি করে দেন বা তহবিলের অভাবে মূল্য সমন্বয় করতে পারেন না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তহবিল বড় থাকায় এই মূল্য সমন্বয় খুব একটা সমস্যা হয় না।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংকের বিনিয়োগ বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে শেয়ারের দাম বাড়লে বাজারমূল্যের হিসাবে নির্ধারিত হয় এক্সপোজার লিমিট। ফলে তখন ব্যাংকগুলোতে শেয়ার বিক্রি করে দিতে হয়।
আবার কেনার পর শেয়ারের দাম কমে গেলে তখন আবার হিসাব হয় ক্রয়মূল্যে। ফলে বাড়তি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয় না।
ধরা যাক, কোনো ব্যাংকের বিনিয়োগের সীমা ১০০ টাকা। ব্যাংক ৮০ টাকায় শেয়ার কিনেছে। কিন্তু দাম বেড়ে সে শেয়ারের দাম হয়ে গেল ১১০ টাকা। তখন ব্যাংককে ১০ টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিতে হয়।
আবার উলটোটা হলে অর্থাৎ ৮০ টাকার শেয়ারের দাম কমে ৬০ টাকা হয়ে গেলে তখন ৪০ কিন্তু ৪০ টাকায় আরও বেশি শেয়ার কিনে সমন্বয়ের সুযোগ থাকে না। তখন কেনা যাবে ২০ টাকার শেয়ার।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
দুই বিশ্লেষকের প্রশংসা
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করার এটাই নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কেন সেটি এত দিন বিবেচনা করেনি তা বোধগম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘যখন মিউচ্যুয়াল ফান্ড বা ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনার পর দর কমে যায় তখন প্রভিশনিংয়ের বিষয় থাকে। তারপরও ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে এটি বিবেচনা করায় পুঁজিবাজারে জন্য ভালো হবে।’
মার্চেন্ট ব্যাংক ব্র্যাক ইপিএলের গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের মূলধনের ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এখন প্রতিষ্ঠান সেটি বিবেচনা করে শেয়ার কিনল। কিন্তু সিকিউরিটিজের দর বেড়ে গেলেই বিপাকে পড়েন। সীমা রক্ষায় সিকিউরিটিজ বিক্রিতে বাধ্য হয়।
‘অনেক দিন ধরে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এক্সপোজার লিমিট নিয়ে কথা বলে আসছিল। যেন এটি ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে করা হয়। এখন যেহেতু বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সেহেতু পুঁজিবাজারের জন্য এটি ভালো উদ্যোগ।’
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সীমা নির্ধারণ করে নির্দেশনা জারির আগে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: নিউজবাংলা
আরও যেসব সিদ্ধান্ত
বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বৈঠকটি হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা আদেশ নিয়ে।
সেখানে আলোচনা হয় বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে। কথা হয়, পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করবে, এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সমন্বয় করে কাজ করবে।
বৈঠকে মোট সাতটি সিদ্ধান্ত হয় বলে জানানো হয়েছে বিএসইসির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে এক্সপোজার হিসাব গণনা ছাড়া বাকি বিষয়গুলো হলো:
১. ব্যাংকের সর্বোচ্চ লভ্যাংশের সীমা ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে।
২. আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ (শেয়ারপ্রতি দেড় টাকা) নগদের পাশাপাশি লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারবে।
৩. তফসিলি ব্যাংকগুলো ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৪. বিশেষ মিউচ্যুয়াল ফান্ড (এসপিএফ) এ তফসিলি ব্যাংকগুলোর ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত সার্কুলারে কিছুটা পরিবর্তন এনে এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সম্পদভিত্তিক বিধিমালা) ২০০৪ এ যুগোপযোগীর মাধ্যমে এসপিডির তহবিল সম্পদভিত্তিক সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পাশাপাশি অন্যান্য ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজ যেমন সুকুক, করপোরেট বন্ড, গ্রিন বন্ড ইত্যাদিতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করা হয়েছে।
৫. সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে পুঁজিবাজারের সকল স্তরের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি যৌথভাবে কাজ করবে।
৬. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে কর প্রদান-সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যে সার্কুলার আছে, সেটি বাতিলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।