বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিরূপ অভিজ্ঞতায় নগদ লভ্যাংশে জোর

  •    
  • ১২ মার্চ, ২০২১ ১৪:৪৩

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার পরিশোধিত মূলধন বাড়ালেও এমন বহু কোম্পানি আছে যারা পুনর্বিনিয়োগ করে কোম্পানির স্বাস্থ্য বাড়াতে পারে না। বরং গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কোনো বছরে শতভাগ বা তার চেয়ে বেশি বোনাস ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শেয়ারের দর আকাশচুম্বি হয়ে যায়। কিন্তু পরে বিনিয়োগকারীরা ঠকে থাকে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার কোম্পানিকে শর্ত দেয়া হয়েছে, লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারধারীদেরকে পাঁচ বছর বোনাস শেয়ার দেয়া যাবে না।

চলতি বছর তালিকাভুক্ত হওয়া ই জেনারেশনকেও চার বছর লভ্যাংশ দিতে হবে নগদে।

কেবল বোনাসে লভ্যাংশ দিলে তাদেরকে দিতে হবে বাড়তি কর- এটা ঠিক করে দিয়েছে সরকার।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার পরিশোধিত মূলধন বাড়ালেও এমন বহু কোম্পানি আছে যারা পুনর্বিনিয়োগ করে কোম্পানির স্বাস্থ্য বাড়াতে পারে না। বরং গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কোনো বছরে শতভাগ বা তার চেয়ে বেশি বোনাস ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শেয়ারের দর আকাশচুম্বি হয়ে যায়। কিন্তু পরে বিনিয়োগকারীরা ঠকে থাকে।

এই বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও নগদ লভ্যাংশ নিয়ে আগ্রহ যে বাড়তে শুরু করেছে, সেটাও স্পষ্ট। পুঁজিবাজারকেন্দ্রীক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে নানা পোস্টেও নগদ লভ্যাংশের পক্ষে লিখে থাকেন তারা।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসিও এখন নগদ লভ্যাংশে জোর দিচ্ছে।

বোনাস লভ্যাংশ দেয়ার বিপরীতে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ টাকা নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে তা দিয়ে যে কোনো উন্নয়ন হচ্ছে তা বছর শেষে কোম্পানিগুলোর শেয়ার প্রতি আয় ও মুনাফা দেখেই অনুমেয়।

আবার বোনাস লভ্যাংশ দিলে বিনিয়োগকারীদেরও খুব একটা লাভ হয় এমন না। কারণ, যে পরিমাণ শেয়ার যোগ হয়, দামও তার সঙ্গে সমন্বয় হয়।

অর্থাৎ ১০০ টাকা দামের কোনো কোম্পানি যদি ১০ শতাংশ বোনাস দেয়, তাহলে রেকর্ড ডেটের পর সে কোম্পানির শেয়ারের দামও ১০ শতাংশ কমবে। কিন্তু নগদ লভ্যাংশ দিলে শেয়ার দরে তা সমন্বয় হয় না।

এমন অবস্থায় বিএসইসি সম্প্রতি পাবলিক ইস্যু বিধিমালার সংশোধনীনের যে উদ্যোগ নিয়েছে সেখানেও নতুন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রথম দুই বছর বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারবে না এমন শর্ত দেয়া হয়েছে।

সদ্য যেসব কোম্পানি অর্থবছর শেষে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করছে তার কারণও এখন ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে ডিএসই ওয়েবসাইটে।

সমাধানে বিএসইসি

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পাবলিক ইস্যু বিধিমালার সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছে। যা বর্তমানে খসড়া আকারে মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত মতামত প্রদান করা যাবে এই খসড়ায়।

যেখানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েই বিনিয়োগকারীদের প্রলোভন দেখিয়ে বড় অংকের বোনাস লভ্যাংশে দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির পথ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, নতুন তালিকাভুক্ত হওয়ার শুরুর দুই বছর কোনো বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো যাবে না।

বিএসইসির পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও নতুন তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া কোম্পানিগুলোকে বোনাস শেয়ার দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করা হচ্ছে কি না প্রশ্নে কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগ নেয়ার কিছু নেই। লভ্যাংশ দেয়ার বিষয়ে আয়কর পরিপত্রে বলা আছে। আমরা সেটিকে অনুসরণ করছি। তবে কোম্পানির উন্নয়নের উদ্দেশ্য ছাড়া যারা বোনাস লভ্যাংশ দিতে চায় তাদের নজরদারি করা হচ্ছে।’

দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রধান কার্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা

কী আছে পরিপত্রে

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য মোট লভ্যাংশের অর্ধেক নগদ দেয়ার বিধান রাখা আছে। অন্যথায় অতিরিক্ত করারোপের মুখে পড়তে হবে কোম্পানিকে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে বোনাস লভ্যাংশের সমপরিমাণ নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি বোনাসের পরিমাণ নগদের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে পুরো বোনাস শেয়ারের উপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করার বিধান রয়েছে।

তবু নগদ লভ্যাংশ দেবে না প্যারামাউন্ট

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের ২৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশের প্রস্তাব করেছে। কিন্ত আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী কোম্পানিটির সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করার কথা।

এমন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের সচিব ঝর্ণা পারুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইন সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। তবে আমাদের যে মুনাফা হয়েছে তাতে অতিরিক্ত কর দিলেও আমরা বোনাস দিতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানির উন্নয়নের জন্যই এ বছর বোনাস দেয়া হয়েছে। এবং আমাদের এক্ষেত্রে কোনো আইনের ব্যত্যয় হয়নি।’

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ১৯তম বার্ষিক সাধারণ সভায় অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত

বড় বোনাসে বড় ক্ষত

মুন্নু অ্যাগ্রোর ২০১৮ সালে ৩৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে শেয়ার মূল্য প্রায় ছয় হাজার টাকা উঠে যায়। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যবসা বাড়াতে পারেনি। পরের দুই বছরে তারা যথাক্রমে ২০ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়। কিন্তু তাদের আয় ক্রমেই কমছে। বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক লোকসানে আছেন।

আরেক আলোচিত কোম্পানি স্টাইলক্রাফট ২০১৭ সালের জন্য ৮০ শতাংশ, ২০১৮ সালের জন্য ৪১০ শতাংশ, ২০১৯ সালের জন্য ১৫০ শতাংশ বোনাস দিয়ে তিন বছরেই শেয়ার সংখ্যা ২৩ গুণ করে। কিন্তু তারাও ব্যবসা বাড়াতে পারেনি। উল্টো ২০১৬ সালে শেয়ার প্রতি ৯৫ টাকা মুনাফা করা কোম্পানিটি পরিণত হয়েছে লোকসানিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তারা শেয়ার প্রতি এক টাকা ৮ পয়সা লোকসান দিয়েছে।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে দুই বছরের মধ্যে শেয়ার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন গুণ করে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেমিনি সি ফুড। বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণে কোম্পানিটি গত বছর কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে লোকসান আরও বেড়েছে।

২০১৭ সালে প্রথমবার ৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ২০ টাকা ৭১ পয়সা। পরের বছর ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার বছরে আয় কমে হয় ১৩ টাকা ৬ পয়সা। ২০২০ সালে সেই কোম্পানি শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ৯ টাকা ৮৩ পয়সা।

ব্যাংকিং খাতের ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রায় এক দশক পরে ২০১৮ সালে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়। এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ওই বছর শেয়ারদরও বেড়ে যায় শতভাগের বেশি। উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে এখন বিপাকে বিনিয়োগকারীরা।

২০১৩ সালে তালিকাভুক্তির পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত বছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে আলোচনায় আসা ফ্যামিলি টেক্সের বিনিয়োগকারীরা আরও বিপাকে। ওই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শেয়ারদর ৭৪ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও পরে মালিকরা ঘোষণা না দিয়ে উচ্চমূল্যে শেয়ার বিক্রি করে লাপাত্তা হয়ে যান। এখন শেয়ারদর কমতে কমতে দুই টাকার ঘরে নেমেছে।

তবে ২০১৮ সালে প্রথম দফায় ২০০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে দ্বিতীয় দফায় আরও ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেও আনুপাতিক হারে দর ধরে রাখতে পেরেছে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, বিএটিবিসি।

যদিও প্রথম দফায় একটি শেয়ারের বিপরীতে দুটি বোনাস শেয়ার দেয়ার পর দাম পড়ে গিয়েছিল। তবে যারা দুই বছর ধরে রেখেছেন, তারা এখন মুনাফায় আছেন।

আবার বোনাস শেয়ার দেয়ার পরেও কোম্পানিটি নগদে বেশ ভালো মুনাফা বিতরণ করতে ভুলেনি। ২০১৮ সালে বোনাসের সঙ্গে শেয়ার প্রতি ৫০ টাকা, শেয়ার তিন গুণ করার পরেও ২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি ৪০ টাকা আর ২০২০ সালে বোনাসের পরও শেয়ার প্রতি ৬০ টাকা নগদ মুনাফা দিয়েছে।

২০১৮ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস দিয়েও দাম ধরে রাখে বহুজাতিক আরেক কোম্পানি বার্জার পেইন্টস। এই কোম্পানিও শেয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরও নগদ মুনাফা দেয়ার প্রবণতা কমায়নি।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বের বেশির ভাগ শেয়ারবাজারে বোনাস শেয়ার দেয়ার রেওয়াজ নেই। শুধু বাংলাদেশেই বোনাস শেয়ার দেয়ার প্রবণতা বেশি।

বোনাস শেয়ার দেয়ার মাধ্যমে আইনগতভাবে কোম্পানিকে দুর্নীতি করার সুযোগ দেয়া হয়। কারণ কোম্পানির আয়ের যে অংশটুকু বোনাস শেয়ারে রূপান্তর করে বিতরণ করা হয় সেটির ব্যবহার হয়না। এর কারণ হচ্ছে কোম্পানির কোনো উন্নতি নেই।

দেবব্রত বলেন, কোম্পানি যে ব্যবসা করছে তার প্রমাণ হচ্ছে বছর শেষে নগদ লভ্যাংশ প্রদান। আর বোনাস দিয়ে বিনিয়োগকারীদের হাতে এ ধনের কাগজ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে, যার বিক্রি করে লাভও হতে পারে আবার লোকসানও হতে পারে।

‘এনবিআরের একটি আইন আছে যেখানে লভ্যাংশ সংক্রান্ত নির্দেশান দেয়া আছে। কিন্ত কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত কর দিয়ে প্রস্তুত কিন্ত নগদ লভ্যাংশ দিতে রাজি নয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিকে নগদ লভ্যাংশে আগ্রহী করতে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করা যেতে পারে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তবে কোম্পানি কেন, কি জন্য বোনাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আগেই কমিশন থেকে অনুমোদনের নিয়ম করা উচিত।

এ বিভাগের আরো খবর