রিংসাইন টেক্সটাইলের পর এবার বিমান ও পরিবহন খাতের ডুবে যাওয়া কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানিটিকে আবার চালু করে বিনিয়োগকারীদের জলে যাওয়া টাকা পুনরুদ্ধারের চিন্তা করা হচ্ছে।
বিষয়টি এখনও প্রাথমিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যদিও রিংসাইনের ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিএসইসি মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রিংসাইন টেক্সটাইলের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজেরও করা হবে। সিভিল অ্যাভিয়েশনে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়েই এটা করা হবে। তবে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
পাঁচ বছর ধরে কার্যক্রম বন্ধ থাকা, বার্ষিক সাধারণ সভা না করা, লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে ২০১০ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটিকে মূল বাজার থেকে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের পর কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী আর তৈরি হয়নি। কোম্পানির উড়োজাহাজগুলো বিমানবন্দরে ফেলে রাখা হয়েছে। সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে পাওনা ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ করার অভিযোগ উঠেছে। বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম যখন ছয় শ থেকে সাড়ে সাত শ টাকা ছিল, সে সময় পরিচালক ও উদ্যোক্তারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
কোম্পানিটির ৮২ কোটি শেয়ারের মধ্যে কেবল আড়াই শতাংশ এখন মালিকপক্ষের হাতে আছে, যদিও বিএসইসির করা বিধান অনুযায়ী কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে তাদের হাতে। বারবার তাগাদা দিলেও শেয়ার কেনেনি তারা।
বিএসইসি এর আগে রিংসাইন টেক্সটাইলের পর্ষদ পুনর্গঠন করে বন্ধ কোম্পানি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে
কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়ার পর ৭২ কোটি শেয়ারের মালিকদের টাকা কার্যত নাই হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কোম্পানিটিকে নতুন করে চালু করতে পারলেই কেবল এই শেয়ার আবার তার মূল্য ফিরে পাবে।
কোম্পানির পুনর্গঠনের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারের সহকারী পরিচালক জহিরুল ইসলাম অবশ্য কিছু জানাতে পারেননি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অফিশিয়ালি এখনও কোনো চিঠি আসেনি। এলে জানানো যাবে। তবে পর্ষদ পুনর্গঠন করার পর কোম্পানিটি চালু হলে সবার জন্যই ভালো হবে।’
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি রিংসাইন টেক্সটাইলের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর প্রতিষ্ঠানটির কারখানা চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
বর্তমান পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দাবি
কোম্পানি পুনর্গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বর্তমান উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আনম আতাউল্লাহ নাঈম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। পর্ষদ পুনর্গঠন করে কোম্পানিটি চালু করা হলে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবে। কিন্তু এই কোম্পানিকে সামনে রেখে যারা শ শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের কী হবে?’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে কোম্পানি নিয়ে এসে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ বন্ধ করা উচিত। পর্ষদ পুনর্গঠনের পাশাপাশি তাদেরও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরবে। পুঁজিবাজারে বর্তমানে মন্দা চলছে তাতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে না রেখে লেনদেনে নিয়ে আসলেও অনেক সমস্যা সমাধান হবে।’
ওটিসিতে বিপুল শেয়ার বিক্রির আদেশ, ক্রেতা নেই
মূল মার্কেটে থেকে সরিয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) লেনদেন শুরু হওয়ার পর বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির আদেশ পড়েছে, যা ইতিপূর্বে অন্য কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে হয়নি।
১৭ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কোম্পানির ১ কোটি ৬১ লাখ ১২ হাজার ৩৩০টি শেয়ার বিক্রির আদেশ দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি শেয়ারও বিক্রি হয়নি।
গত ১৪ জানুয়ারি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় কোম্পানিটিকে মূল মার্কেট থেকে সরিয়ে ওটিসি মার্কেটে স্থানান্তর করতে ডিএসই ও সিএসইকে নির্দেশ দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি।
আর্থিক প্রতিবেদন না থাকা, নিয়মিত লভ্যাংশ না দেয়াসহ দুর্বল মৌলভিত্তি ও উচ্চঝুঁকি বিবেচনায় কোম্পানিকে ওটিসি মার্কেটে তালিকাভুক্ত করা হয়।
শেয়ার বিক্রির জন্য সর্বনিম্ন ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২ টাকা ১০ পয়সা পর্যন্ত দর দেয়া হয়েছে।
এক লাখ থেকে তিন লাখের মধ্যে শেয়ার বিক্রির আদেশ আছে প্রায় ৪০টির বেশি।
২৫ জানুয়ারি ফিনিক্স সিকিউরিটিজ থেকে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৫টি শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে।
তুমহা সিকিউরিটিজের পক্ষ থেকে গত ২৬ জানুয়ারি ১ টাকা ৭০ পয়সায় ৪ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রির আদেশ দেয়া হয় ।
২২ ফেব্রুয়ারি আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে সবচেয়ে বেশি ২৩ লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ দেয়া হয় ১ টাকা ৯০ পয়সায়।
ওটিসিতে কীভাবে লেনদেন হয়
ওটিসি মার্কেটে সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে এর লেনদেন প্রক্রিয়া। মূলত যে সব কোম্পানি কাগজে শেয়ার থেকে ইলেক্ট্রিনিক বা ডিমেট শেয়ারে রূপান্তর করেনি সেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয় ওটিসিতে।
কিন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার ডিমেট থাকার পর পুঁজিবাজারে মূল মার্কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ওটিসিতে পাঠানো হয়েছে।
ওটিসি মার্কেটে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে প্রথমে বিনিয়োগকারীকে তার ব্রোকার হাউজের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।
সেটি ডিএসইতে জমা হওয়ার পর তা ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হয়। ব্রোকার হাউজ সেই শেয়ার লেনেদেন প্রক্রিয়া শেষ করে ডিএসইকে জানাবে। তা অনুমোদন হওয়ার পরই বিনিয়োগকারীর বিও হিসেবে শেয়ার জমা হবে।
ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী জানান, ইলেকট্রনিক শেয়ার হাতবদলের জন্য ওটিসির বাইরে আরও একটি প্লাটফর্ম তৈরির কাজ চলছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এসএমই মার্কেট, ডেভিভেটিভ মার্কেট চালুর কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। তখন হয়তো যেসব কোম্পানির শেয়ার ডিমেট করা আছে সেগুলোকে ওটিসিতে না পাঠিয়ে নতুন চালু করা মার্কেটে পাঠানো সম্ভব হবে। তখন লেনদেনের এমন জটিলতা থাকবে না।’
ইউনাইটের আর্থিক অবস্থা
২০১০ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি পুঁজিবাজারের মৌল ভিত্তি ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত ছিল। মূলত ২০১৫ সালের পর থেকে দুর্বল হতে থাকে কোম্পানিটি।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১১ বছরে কোম্পানিটির কাছে থাকা ৮২ কোটি ৮০ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ৭১ কোটি ৫৭ লাখ শেয়ার তুলে দিয়েছে সাধারন বিনিয়োগকারীদের কাছে।
কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ শেয়ার। যেখানে আইন অনুযায়ী কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার কথা।
বতর্মানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৮২৩ কোট টাকা।
কোম্পানির সর্বশেষ আর্থিক বিবরণী তৈরি করা হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের। সেখানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানি কোনো আয় নেই। তবে ২০১৬ সালের রেভিনিউ দেখানো হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে ব্যাংকের এফডিআর থেকে আয় হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার ৬০৩ টাকা।