টানা পাঁচ কার্যদিবস পতন হলো দেশের পুঁজিবাজারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাজার বিশ্লেষক, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারী- কেউই সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত উত্থানে যারা বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরার আশা করছিলেন, তারা হতাশ। দিতে দিনে বাড়ছে এই হতাশা।
পুঁজিবাজারে এই দশা তৈরি হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেদিন বাজারের সূচক ছিল ৫ হাজার ৮৩৬ পয়েন্ট। সেটি কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩১৭ পয়েন্টে।
২২ কার্যদিবসে সূচক পড়ল ৫১৯ পয়েন্ট। এর মধ্যে মাঝে সূচক বেড়েছে সাত দিন। কমেছে বাকি ১৫ দিন।
শেয়ারগুলো দাম হারানোর কারণে বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে গেছে বাজারে। এ কারণে লেনদেনেও নেই গতি।
ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির শুরুতে টানা ১০ দিন যেখানে গড়ে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে, সেখানে এখন হাতবদল হচ্ছে ৪০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার ভেতরে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারের দর যখন বেড়েছিল তখন অনেকেই শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলেছেন। অনেকে অপেক্ষায় ছিলেন এই মন্দা থেকে শিগগিরই বের হয়ে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় আরও বেশি লোকসান থেকে বাঁচতে তারা শেয়ার বিক্রি করছেন। মূলত এ কারণেই লেনদেন বাড়ছে না, বরং কমছে।
মঙ্গলবার লেনদেনের শুরু হয় সূচকের উত্থানে। লেনদেনের শুরুর ১৫ মিনিট পর্যন্ত চলে এ উত্থান। তারপর কিছুটা কমে আসে।
বিনিয়োগকারী আসলাম ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন থাকবে। এটা যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন তারা সবাই জানেন। কিন্তু ক্রমাগত দরপতন হলে সেটা প্রত্যাশিত নয়। কারণ, পুঁজিবাজারে এক গ্রুপ শেয়ার কিনবে, আরেক গ্রুপ শেয়ার বিক্রি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শেয়ার বিক্রির পর দর কমে যায়, তখন কারা কিনবে। তারা এখন কোথায়?’
কী বলছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সব সূচক ভালো, কোনো সহিংসতা নেই, তারপরও পুঁজিবাজারে এর কোনো প্রভাব নেই।’
বিএসইসি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেভাবে দায়িত্ব পালন করছে তাতে কোনো ত্রুটি নেই। তবে মার্কেট প্লেয়ার যারা, তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটা দেখা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুঁজিবাজারে মন্দা দীর্ঘ হলে ক্ষতি যেটা হয় তা হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা অস্থির হয়ে যান। তারা মুনাফার চেয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসান কমিয়ে আনা কিংবা সমন্বয় করতে চান। কিন্তু প্রতিনিয়ত দর পড়তে থাকলে সমন্বয় করাও বন্ধ করে দেন। ফলে লেনদেন প্রতিনিয়ত কমে আসে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখন মার্চেন্ট ব্যাংক, আইসিবিকে হাল ধরতে হবে। তা না হলে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর চাপিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।’
দাম কমছে ভালো শেয়ারেরও
মঙ্গলবার লেনদেনে প্রায় সব খাতের কোম্পানির শেয়ারের দর তুলনামূলকভাবে কমেছে।
ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে সাতটির। আর দর কমেছে ১৫টির। পাল্টায়নি আটটির দর।
প্রকৌশল খাতেও ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর পাল্টায়নি ১৯টির, দর বেড়েছে ৯টির। বাকি ১৪টির দর কমেছে।
টানা পাঁচ কার্যদিবস পড়ল পুঁজিবাজারের সূচক। মঙ্গলবারের লেনদেন শেষে বাজারের অবস্থান
ব্যাংকবহির্ভূত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে চারটির। পাল্টায়নি ছয়টির। দর কমেছে ১৩টির।
বিমা খাতেও একই অবস্থা দেখা গেছে। ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে আটটির। পাল্টায়নি আটটির। আর দর কমেছে ৩৩টির।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২১ কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১০টির, দর কমেছে ছয়টির। দর পাল্টায়নি পাঁচটির।
৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে দুটির, কমেছে ২০টির, পাল্টায়নি ১৫টির।
ব্ল চিপ কোম্পানির ১৯টির দরপতন
পুঁজিবাজারের সবচেয়ে ভালো ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠন করা হয়েছে ডিএস-৩০ সূচক। মঙ্গলবার এই সূচক ৩৯ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৭ পয়েন্টে।
এই শেয়ারগুলোর মধ্যে দর কমেছে ১৯টির, দর বেড়েছে ৯টির, পাল্টায়নি দুটির।
এদিন সবচেয়ে বেশি দর কমেছে বেক্সিমকো লিমিটেডের ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার দর ৮৮ টাকা ২০ পয়সা থেকে নেমেছে ৮১ টাকা ৩০ পয়সায়।
বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার দর কমেছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কোম্পানির শেয়ার দর ১৮০ টাকা ৮০ পয়সা থেকে নেমেছে ১৭২ টাকা ৭০ পয়সায়।
বিএসআরএম লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংকের ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, লংকাবাংলা ফিন্যান্সের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এই সূচকে থাকা মেঘনা পেট্টোলিয়াম ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দর বেড়েছে সবচেয়ে বেশি যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
লেনদেনে বেক্সিমকোর অবদান ৩১ শতাংশ
পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি ফ্রি ফ্লোট শেয়ার নিয়ে লেনদেনে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেড মঙ্গলবারও বড় ভূমিকা রেখেছে পুঁজিবাজারে।
এদিন বেক্সিমকো লিমিটেডের ২ কোটি ১৮ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩১ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সদ্য লভ্যাংশ ঘোষণা করা বেট বাংলাদেশ-বিএটিবিসি, যার ২ লাখ ৪৩ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৭ কোটি টাকায়। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দরে উত্থান-পতন থাকলেও দিন শেষে আগের দিনের মতো অপরিবর্তিত ছিল।
তৃতীয় অবস্থানে ছিল বেক্সিমকো ফার্মা, যার ১ কোটি ৯১ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়।
এ ছাড়া লংকাবাংলা ফিন্যান্স, রবি, স্কয়ার ফার্মা, ওয়ালটন ছিল এই তালিকায়।
সূচক ও লেনদেন
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের-ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৭ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩১৭ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৫ দশমিক ৩১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০৬ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ৩৩৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৬৬টির, কমেছে ১৫৬টির, পাল্টায়নি ৮৩টির দর।
এ সময় ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৫৯১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এটি আগের দিনের তুলনায় ১২৪ কোটি টাকা বেশি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে- সিএসই প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৮১ দশমিক ৪১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৩৮৩ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ১৯৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৪৫টির, কমেছে ৯৯টির, পাল্টায়নি ৫১টির। এ সময় সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৬ কোটি টাকা।
আগ্রহ ও অনাগ্রহের কোম্পানি
মঙ্গলবার ডিএসইতে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ দর বেড়েছে নতুন তালিকাভুক্ত ই জেনারেশন লিমিটেডের।
লেনদেন শুরুর প্রথম দুই দিন ৫০ শতাংশ করে দর বাড়তে পারে। এই কোম্পানির ক্ষেত্রে বেড়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণেই। তবে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। তিনবারে ২০১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এই দামে ১৩ কোটি ৪৭ লাখেরও বেশি শেয়ার ক্রয়ের আদেশ থাকলেও কেউ বেচতে রাজি ছিলেন না।
৯.৬১ শতাংশ দাম বেড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল আরামিট সিমেন্ট।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দাম বেড়েছে ৮.৫৭ শতাংশ।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা ফারইস্ট ফিন্যান্সের দাম বেড়েছে ৮.৩৩ শতাংশ।
জিবিবি পাওয়ার, আমান কটন, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, রবি, তৌফিকা অ্যাগ্রো (লাভেলো আইসক্রিম) ও রেকিট বেনকাইজার ছিল সর্বাধিক দর বৃদ্ধির তালিকায়।
দরপতনের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল এনসিসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, যার দর কমেছে ১০ শতাংশ।
৭ দশমিক ৮২ শতাংশ দর কমেছে বেক্সিমকো লিমিটেডের। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
এ ছাড়া প্রাইম ফিন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আনলিমা ইয়ার্ন, শাইনপুকুর সিরামিক, জেএমআই সিরিঞ্জ, জিলবাংলা, ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স, জিলবাংলা সুগার ও বেক্সিমকো ফার্মার নাম ছিল সর্বাধিক দর হারানোর তালিকায়।