বুকবিল্ডিং প্রক্রিয়ায় কারসাজি করে মাত্রাতিরিক্ত দাম নির্ধারণ ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিলামের যে নতুন নিয়ম ঠিক করেছে, তা প্রথমবার কার্যকর হচ্ছে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ক্ষেত্রে।
কোম্পানির শেয়ারের প্রান্তসীমা মূল্য (কাটঅপ প্রাইস) নির্ধারণে সোমবার যোগ্য বিনিয়োগকারীদের নিলাম শুরু হবে। চলবে বুধবার পর্যন্ত।
নিলামের এই নতুন নির্দেশনা জারি হয় গত ১ ফেব্রুয়ারি। যেখানে যোগ্য বিনিয়োগকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়াগকারীদের কোম্পানির শেয়ার মূল্য নির্ধারণে বেশ কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
কোম্পানিটি আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ২২৫ কোটি টাকা মূলধন তুলবে। এই টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও আইপিও বাবদ খরচসহ সাবসিডিয়ারি কোম্পানি কর্ণফুলী পাওয়ার ও বারাকা শিকলবাহা পাওয়ারে বিনিয়োগ করা হবে।
এই নিলামকে ঘিরে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি রয়েছে। কারণ, গত কয়েক বছরে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে।
২০১৮ সালে রানার অটোমোবাইলের দর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ঠিক করেন ৭৫ টাকায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ১০ শতাংশ ছাড়ে এই শেয়ারটি পেয়েছেন ৬৭ টাকায়। দুই বছর যেতে না যেতেই পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর কমে হয়েছে ৪৯ টাকা ৩০ পয়সা।
একই বছর তালিকাভুক্ত বসুন্ধরা পেপার মিলের নিলামে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের দর নির্ধারণ করেন ৮০ টাকা। বিএসইসির নির্ধারিত ১০ শতাংশ ছাড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটি পেয়েছন ৭২ টাকায়। সেই শেয়ারের দর এখন কমতে কমতে প্রায় অর্ধেক হয়ে ৪০ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়েছে এসকোয়ার নিট কম্পোজিটের শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিনেছিলেন ৪০ টাকায়। প্রাতিষ্ঠনিক বিনিয়োগকারীরা ১০ শতাংশ বেশি দরে পেয়েছেন ৪৫ টাকায়।
বারাকা পতেঙ্গা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইঞ্জিন হলরুমের ছবি
লেনদেন শুরুর মাত্র দেড় বছরের মাথায় শেয়ার প্রতি ৫৯ শতাংশ দর হারিয়ে লেনদেন হচ্ছে ২৩ টাকা ৬০ পয়সায়।
আমান কটনের শেয়ার দর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নির্ধারণ করে দিয়েছিলে ৪০ টাকা। তা থেকে ছাড়কৃত দর ৩৬ টাকায় আইপিওতে শেয়ার পেয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারে এখন কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ২৯ টাকা ৮০ পয়সায়।
যেভাবে হবে মূল্য নির্ধারণ
নতুন নিয়মে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এরমধ্যে আছে কোম্পানির প্রকৃত সম্পদ মূল্য, শেয়ার প্রতি আয় এবং লভ্যাংশের হিসাব বা ইল্ড।
প্রকত সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে যে মূল্য নির্ধারণ করা হবে যেখান থেকে কোম্পানির ভুয়া সম্পত্তি, মন্দ ঋণ, অগ্রাধিকার শেয়ার, দাবিকৃত ও প্রস্তাবিত লভ্যাংশ হিসাব থেকে বাদ যাবে।
ইল্ড বা লভ্যাংশের হিসাব নির্ধারণে কোম্পানির গত ৫ বছরের কর পরবর্তী মুনাফাকে কোম্পানির শেয়ার প্রতি প্রিমিয়াম থাকলে সেটিসহ পরিশোধিত মূলধন দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করলে যে মূল্য পাওয়া যাবে সেটি নিতে হবে।
কোম্পানির শেয়ারের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে নেট সম্পদ পদ্ধতি এবং ইল্ডের মধ্যেমে যে মূল্য পাওয়া যাবে একটি গড় মূল্য নির্ধারণ করা হবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত দেয়া হয়েছে দরদাতাকে নির্ধারিত ন্যায্যমূল্যের এক পয়েন্ট টু গুণের বেশি মূল্য দিতে পারবে না।
মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি নিলামে অংশ নিতে আগ্রহী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান একটি কমিটি গঠন করবে। এদের মধ্যে দুই জনের নিলাম সম্পর্কে জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বারাকা পতেঙ্গা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে কর্মীদের ছবি
একই সঙ্গে ওই কমিটির সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। গঠিত কমিটির সুপারিশ করবে কারা নিলামে অংশগ্রহণ করবে। তাদের যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষমতা থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
নিলাম শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তবে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে যেন অসঙ্গতি আছে কি না তা যাচাই করা সম্ভব হয়। প্রতিবেদনে কোনো ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নির্ধারিত মূল্যে সর্বনিম্ম দরের ছাড়কৃত দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পেয়ে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যে দরে শেয়ার পান, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তার থেকে ১০ শতাংশ কমে পান।
আর্থিক বিবরণী
৩০ জুন ২০২০, সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক বিবরণী অনুসারে, পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া (আন অডিটেড) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) সম্মিলিতভাবে ২৩ টাকা আর এককভাবে ২০ টাকা ৯৮ পয়সা।
সম্পদ মূল্যায়ন করা হলে এনএভি বাড়তে বা কমতে পারে। একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ৪ টাকা ৩৭ পয়সা।
কী আছে বারাকা পতেঙ্গায়
পুঁজিবাজারে বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার।
২০০৭ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ৫১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য বারাকা পাওয়ারের যাত্রা শুরু হয়।
২০১৪ সালে চট্টগ্রামে ৫০ মেগাওয়াটের ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পায় বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার।
এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর কোম্পানিটি দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করে। এর একটি কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড এবং অন্যটি হলো বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার লিমিটেড।
সাবসিডিয়ারি দুটির ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার।
বিশ্বব্যাংক প্রথম প্রাইভেট খাতের পাওয়ার প্ল্যান্ট হিসেবে বারাকা পাওয়ারে বিনিয়োগ করেছে। কোম্পানিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইপিপিএফ প্রজেক্ট সেলের মাধ্যমে ২ কোটি ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটি।
১১০ মেগাওয়াটের কর্ণফুলী পাওয়ার ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যা ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০১৯ সালের মে মাসে। এটির উৎপাদনক্ষমতা ১০৫ মেগাওয়াট।
এমডি, চেয়ারম্যান ও সচিবের বক্তব্য
বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুর কাদির শাফি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা ডি-সালফারাইজেশন প্রযুক্তির প্লান্ট স্থাপন করেছি। সঞ্চালন লাইনের অভাবে আমাদের দুটি সাবসিডিয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে শতভাগ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আগামী মে মাসে আশা করছি শতভাগ উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে, তখন আয় আরও বাড়বে।’
কোম্পানিটির চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশজুড়ে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিলের বড় অংশই কর্ণফুলী পাওয়ার ও শিকলবাহা পাওয়ারে ইকুইটি বিনিয়োগের কাজে ব্যয় করা হবে।
কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ রানা বলেন, ‘বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানির মূল্য নির্ধারণের নতুন যে নিয়ম দেয়া হয়েছে তা আমাদের কোম্পানি থেকেই শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বুক বিল্ডিং দর প্রস্তাব বা নিলামে অংশগ্রহণের জন্য যে কমিটি করার কথা, সেটি আরও চার বছর আগেও ছিল। এখন শুধু মূল্য নির্ধারণের কিছু পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে যে বিষয়গুলো বলা হয়েছে সেগুলো যোগ্য বিনিয়োগাকারীদের ভালোভাবে জানতে হবে। তা না হলে নির্ধারিত শর্তগুলোর একটি বা দুটি ভুল হলেই কোম্পানির শেয়ার দর নির্ধারণ ভুল হবে।’