গত দুই বছরে এত বড় পতন দেখেনি দেশের পুঁজিবাজার। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দুই শতাধিক কোম্পানির শেয়ারে মূল্য পতনে এক দিনেই সূচক কমেছে আড়াই শতাংশ।
রোববার সকাল ১০টায় লেনদেন শুরু হতেই ছয় পয়েন্ট বেড়ে গেলেও এরপর থেকে টানা পড়তে থাকে সূচক।
টানা পাঁচ কার্যদিবস পতনের পর গত সপ্তাহের বুধ ও বৃহস্পতিবার সূচকের উত্থানে বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হন। এক হাজার আটশ পয়েন্ট সূচক বাড়ার পর তিনশ পয়েন্টের মতো সংশোধন শেষে এই উত্থানে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা জন্মে যে মূল্য সংশোধন বুঝি শেষ হয়েছে।
তবে এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মূল্য সংশোধন শেষ হয়নি। বরং প্রায় দেড়শ পয়েন্ট পতনে বাজার নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা।
২০১৮ সালের ১৮ মার্চ ১৬৮ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশে যখন প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা, তখন কেন এই পতন, ভাবিয়ে তুলেছে বাজার সংশ্লিষ্টদের।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলছেন এই পতন স্বাভাবিক কি না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে পতনের কারণ অনুসন্ধান করার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে যখন উত্থান শুরু হয়েছিল তখন কয়েকটি কোম্পানির সবচেয়ে বেশি লেনদেন ছিল দৃশ্যমান। এখন সেগুলোর দামও তলানিতে নেমে এসেছে।
মাঝে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়লে এখন সেগুলোর দাম কমেছে। তবে পতন যাতে দীর্ঘ না হয় সেদিকেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর দেয়া উচিত।
তবে সূচকের এমন পতনের মধ্যেও ভালো অবস্থানে ছিল তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানিগুলোর।
এই খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দর বারা ১০টি কোম্পানির মধ্যে আটটিই বিমা খাতের।
বিমা খাতের দাম বাগার কারণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ-আইডিআরএর এক সিদ্ধান্ত।
বৃহস্পতিবার নির্দেশ আসে, নন-লাইফ বিমা কোম্পানির এজেন্টদের কোন কমিশন দেয়া যাবে না। এতদিন এজেন্টদের বিমার বিপরীতে ১৫ শতাংশ বা তারও বেশি হারে কমিশন দেয়া যেত।
আবার বিমার উন্নয়ন কর্মকর্তাদের প্রিমিয়ামের বিপরীতেও কোনো কমিশন দেয়া যাবে না। তাদের কোনো সুযোগ সুবিধা দিতে হলে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের জন্য যে আলাদা ব্যাংক হিসাব আছে সেখান থেকে স্ব স্ব ব্যাংক হিসাবে বা পে অর্ডারের মাধ্যমে দিতে হবে।
এতে কোম্পানির আয় বেড়ে যাবে- এমন ধারণা থেকে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়েছেন এই খাতে।
সবচেয়ে খারাপ দিন গেছে ব্যাংক খাতে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে। আটটি কোম্পানির দর পাল্টায়নি। বাকি সবগুলোর দর কমেছে।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শেষের চিত্র
বাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সূচকের পতন অল্প অল্প করে হলে বিনিয়োগকারীরা এতটা আতঙ্কিত হন না, যতটা বড় বা একশ উপর পতন হলে।’
তিনি বলেন, যখন সূচক বাড়ছিল, তখন কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দর অনেক বেড়েছিল। সেগুলোর দর এখন অনেক কমে গেছে। পাশাপাশি যেগুলোর দাম তখন বাড়েনি, সেগুলোর দামও কমছে।’
তিনি বলেন, ‘করে যেন শেয়ারের দর কমছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তা খতিয়ে দেখা উচিত।’
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী মোরশেদ আলম বলেন, ‘শেয়ার বাজারে শেয়ারের দর উত্থান পতন হবেই। কিন্ত কেন ক্রমাগত দর কমছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শেয়ার বাজারে কেন পতন তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা পুঁজিবাজারের জন্য অনেক উদ্যোগ নিচ্ছি। কিন্ত যার সবগুলোই পুঁজিবাজারবান্ধব। তারপরও কেন বাজারের লেনদেন বাড়ছে না তা দেখা হবে।’
সূচক ও লেনদেন
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে-ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৫০৪ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানিগুলো নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৩৫ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৮২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৯১ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ৩৫৩টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৪৩টির, কমেছে ২২৪টির ও পাল্টায়নি ৮৬টির।
মোট লেনদেন হয়েছে ৭৭১ কোটি টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৭১৩ কোটি টাকা। ফলে এক দিনের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৫৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে-সিএসই প্রধান সূচক সিএএসপিআই ৪১৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯১৬ পয়েন্টে।
২২৪টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৩০টির, কমেছে ১৫১টির ও পাল্টায়নি ৪৩টির। লেনদেন হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা।
আগ্রহ ও অনাগ্রহের শীর্ষে যারা
লেনদেনের শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড, যার এক কোটি ৫৮ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা।
বৃটিশ আমেরিকা ট্যোবাকো বাংলাদেশ লিমিটেড-বিএটিবিসি চার লাখ ৯৮ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা।
তৃতীয় স্থানে ছিল লংকাবাংলা ফিন্যান্সের এক কোটি ২৮ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪৯ কোটি টাকায়। রবির ছিল লেনদেনের চতুর্থ স্থানে, যার এক কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা।
পঞ্চম স্থানে ছিল বেক্সিমকো ফার্মা, যার ১৬ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি টাকায়।
দর বাড়ার তালিকায় প্রথমে ছিল মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ারের দর বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ। প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দর বেড়েছে ২.৬২ শতাংশ। মতিন স্পিনিংয়ের শেয়ার দর বেড়েছে ২.৬২ শতাংশ। তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দর বেড়েছে ২.১৬ শতাংশ।
এছাড়া সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স ও ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের দাম বেড়েছে।
দর পতনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামী মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর কমেছে ৯.৬১ শতাংশ।
নতুন তালিকাভুক্ত মীর আক্তার হোসাইন লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ৯.৪২ শতাংশ।
শাইনপুকুর সিরামিকের দর কমেছে ৯.১২ শতাংশ। অ্যাপোলো ইস্পাতের শেয়ার দর কমেছে ৯.০৯ শতাংশ।
এ তালিকায় ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড, জি কিউ বলপেন, লংকাবাংলা ফিন্যান্স, সাইফ পাওয়ার টেক, ফুওয়াং ফুড ও বেক্সিমকো ফার্মা।