বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চালে অস্বাভাবিক মুনাফায় মিল মালিকরা

  •    
  • ৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:৩০

উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রতি কেজি চালে ১১ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছেন মিল মালিকরা। এটি স্বাভাবিক সময়ে এক থেকে দুই টাকা হয়ে থাকে।

আমন ধান ওঠার পর চালের উচ্চমূল্য। আমদানির অনুমতি। এই ঘোষণায় যে খুচরা বাজারে কোনো প্রভাব পড়েছে, এমন নয়। যদিও মিলগেটে দাম কিছুটা কমেছে।

এক মাসের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা। এক বছরের হিসাব নিলে আরও অস্বাভাবিক ঠেকে।

৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ বেড়েছে শতকরা হিসাবে, আর অঙ্কে ১৩ থেকে ১৫ টাকা।

খোদ কৃষিমন্ত্রী বলছেন, কারসাজি হয়েছে। কিন্তু সেটার পেছনেও তো একটি কারণ লাগে। সেটা কী, তা স্পষ্ট নয়।

তবে এটা নিশ্চিত যে, ভোক্তা যে দামে চাল কিনছে, যৌক্তিক মুনাফা করলে দাম আরও কম হতে পারত।

উৎপাদন খরচ থেকে খুচরা পর্যায়ে চাল আসতে আসতে শতকরা ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার তথ্য মিলেছে। কেজিতে টাকায় পার্থক্য দাঁড়ায় ২০ থেকে ২১ টাকা।

নিউজবাংলার অনুসন্ধান বলছে, এই মুনাফার সিংহভাগ করছেন মিল মালিক। কুষ্টিয়ায় প্রতি কেজি চালে ১১ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত মুনাফার প্রমাণ মিলেছে।

মিলগেট থেকে চাল কিনে রাজধানীর আড়তে আনার পর আড়তদার কেজিতে এক থেকে দুই টাকা মুনাফা করেন। এরপর খুচরা ব্যবসায়ীরা মুনাফা করেন আরও চার থেকে পাঁচ টাকা।

চাল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ জেলা নওগাঁয় মিলগেটে প্রতি কেজি চিকন চাল বিক্রি হয় ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে।

ঢাকায় তাহলে এই চাল কেন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, এমন প্রশ্ন নিয়ে মিলার-আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এক জন দায় দেন আরেক জনকে।

মিলাররা বলছেন, আড়তদার বেশি মুনাফা করছেন। আড়তদার বলছেন, দাম বাড়িয়েছেন মিলাররা।

কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, চলতি বছর দুই দফা বন্যার কারণে আউশ ও আমন ফলনের কিছু ক্ষতি হয়েছে। তবে উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান সরকারের হাতে আছে, তাতে চালের এত ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।

গত সেপ্টেম্বর মাসেও বাজারে মিনিকেট চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি ছিল। পাইজাম জাতীয় অন্য সরু চাল ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় মিলেছে।

দাম বাড়ার শুরুটা হয়েছিল করোনাভাইরাস আতঙ্কে।

২০২০ সালের শুরুতে বাজারে সরু মিনিকেট চাল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা কেজি ছিল। মার্চের শেষের দিকে সেটা বেড়ে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা হয়। বাকিটা বাড়ল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে বাড়তি কেনাকাটার কারণে।

উৎপাদন পর্যায়ে দাম কত

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মালশন গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, তিনি বিআর-৪৯ জাতের ধান বিক্রি করেছেন এক হাজার টাকা মণ দরে।

জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘আমরা বাজার থেকে ধান ক্রয় করার পর আড়তদারিসহ লেবার ও পরিবহন বাবদ মিল পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি মণ ধানে ২৫ থেকে ২৮ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে ধান থেকে চাল উৎপাদন ব্যয় দুই রকম। একটি হাসকিং পদ্ধতিতে চাল উৎপাদনে প্রতি মণে খরচ ৬০ টাকা। অটোমেটিক রাইস মিলে প্রতি মণ উৎপাদন খরচ ৮০ টাকা।

‘বর্তমান ধানের বাজার দর এক হাজার ১০০ টাকা। সে হিসেবে ধান কেনা থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত মোট ব্যয় এক হাজার ১৮৫ থেকে এক হাজার ১৯০ টাকার মতো ব্যয় হয়।’

প্রতি মণ ধানে ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। হাসকিং প্রদ্ধতিতে উৎপাদিত চাল বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ৪৪ টাকা ধরে এবং অটোমেটিক রাইস মিলে উৎপাদিত চাল প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ৪২ টাকায়।

মিনিকেট চাল তৈরি হয় যেসব ধান দিয়ে তা কুষ্টিয়াসহ আশপাশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ২৬০ টাকায়। এসব ধান মিলে নিয়ে আসতে খরচ পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। অটো ড্রয়ার মিলে প্রতি মণ ধান থেকে চাল উৎপাদনে শ্রমিক, বিদ্যুৎ বিলসহ খরচ হয় ৬০ টাকা।

যদিও অন্য কোনো ব্যবসায়ী মিলে ধান নিয়ে চাল উৎপাদন করলে মিল মালিক মণপ্রতি ৯০ টাকা খরচ করে থাকেন। চাল পরিবহনের জন্য বস্তা কেনা হয় ৫০ টাকায়। সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে এক হাজার ৪৪৫ টাকা।

৪০ কেজি ধান থেকে চাল হচ্ছে ২৬ থেকে ২৭ কেজি। বাকি ছয় কেজি তুষ হচ্ছে। প্রতি কেজি সাড়ে সাত টাকা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। তিন কেজি পলিশ কুড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা হারে ৭৫ টাকা। ২ কেজি খুদ ও কালো মাছি দানা চাল বিক্রি থেকে আসছে ২৫ টাকা দরে ৫০ টাকা। আর আড়াই কেজি তুষ মিশ্রিত ধুলা বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়।

সব মিলিয়ে চাল ছাড়াও এসব বিক্রি করে মিল মালিকের আসছে ১৭৪ টাকা। এই হিসাবে এক মণ ধান থেকে চাল করতে খরচ হচ্ছে এক হাজার ২৭১ টাকা।

এক মণ ধানে ২৬ কেজি চাল হলে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৮.৮৮ টাকা। আর ২৭ কেজি হলে ৪৭ টাকা।

বেশি লাভ মিলগেটেই

শনিবার কুষ্টিয়ার খাজানগরে মিলগেটে ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চাল দুই হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই হিসেবে কেজি পড়ে ৫৮ টাকা।

এক সপ্তাহ আগেও দাম কেজিপ্রতি তিন থেকে চার টাকা বেশি ছিল। দাম কমার কারণ, সরকারের আমদানির ঘোষণা।

সরকার চাল আমদানির ঘোষণা দেয়ার পর আড়তদারা বেশি করে চাল কিনছেন না বলে জানালেন জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সাধু।

তিনি বলেন, ‘লোকসানের ভয়ে কেউ বেশি করে চাল নিচ্ছেন না। এ কারণে দাম কমছে।’

কুষ্টিয়া সদরের করিমপুর বাজারে শনিবার মিনিকেট ধান এক হাজার ২৫০ টাকা মণ দরে কিনেছেন বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ী জহির রায়হান।

কুমারখালী উপজেলার পান্টি বাজারের ব্যবসায়ী মো. উকিল জানিয়েছেন, বিআর ৪৯ জাতের ধান এক হাজার ১২০ এবং ধানী গোল্ড ধান এক হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ফোর স্টার রাইস মিলের পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মিলগেটে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৯০০ টাকায়। আর ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার খরচসহ পড়েছে দুই হাজার ৯৫০ টাকা।’

কুষ্টিয়ার খাজানগরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম (উৎপাদন ও পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র)। এখানে প্রায় দুই হাজার চাতাল (ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় যেখানে) রয়েছে। আর হাসকিং মিল (ধান ভাঙানোর ছোট মিল) রয়েছে পাঁচ শতাধিক।

বৃহদাকার অটো রাইস মিল রয়েছে ৩৩টি। এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ট্রাক চাল সারা দেশে সরবরাহ করা হয়।

এখানকার মিল মালিকদের বিরুদ্ধে হঠাৎ দাম বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে। হইচই হলে প্রশাসনের সঙ্গে বসে আবার দাম কমিয়ে দেন এসব ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে দুই-এক দিনে মোটা টাকার ব্যবসা করে ফেলেন তারা।

কী বলেছেন ঢাকার ব্যবসায়ীরা

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের বন্ধন রাইস এজেন্সির মিলন হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ৫০ কেজির মিনিকেট কিনি তিন হাজার ১০ টাকায়। আর মোটা চাল কিনি দুই হাজার ৩০০ টাকায়।’

মিলগেটের হিসাব জানালে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘৪৫ টাকা করে কী চাল বিক্রি করে সেটা আগে বোঝা লাগবে। অনেক সময় বিআর-২৮ চাল মিনিকেট লিখে বিক্রি করে। আর ওই দামের সঙ্গে বস্তাপ্রতি এক্সট্রা ৭০ টাকা খরচ হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রশিদ মিনিকেট চাল দুই হাজার ৯৫০ টাকা দিয়ে মিল থেকে কিনেছি। ৬০ টাকা ওনার ভাড়া তার মানে তিন হাজার ১০ টাকা। আমি যে গদিতে বসি সেখানে কারেন্ট বিলসহ অন্যান্য ভাড়া ২৫ টাকা। আর আমি বিক্রি করি তিন হাজার ৪০ টাকা। তাইলে তো আমার লাভ মাত্র পাঁচ থেকে ১০ টাকা থাকে।’

কারওয়ান বাজারের জনতা রাইস এজেন্সির মালিক মো. রাসেল নিউজবাংলাকে বলেন, তারা যে দামে চালের বস্তা কিনে থাকেন, সেখান থেকে কেজিতে এক থেকে দুই টাকা লাভ রেখে বিক্রি করে দেন।

তার দোকানে নাজিরশাইলের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ১০০ টাকা (৬২ টাকা কেজি) দরে আর স্বর্ণা প্রতি ৫০ কেজির বস্তা দুই হাজার ২০০ টাকায় (প্রতি কেজি ৪৪ টাকা)।

মিলগেটে চালের দাম ৪৫ টাকা করে শোনার পর তিনি বলেন, ‘আসলে এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। আমরা তো ঢাকায় ৪৪ টাকা দরে কেনার স্বপ্ন দেখি না।’

রাজধানীর বাবুবাজারের শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন চাল যে দামে বিক্রি হচ্ছে সেটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি। মিল থেকে আমাদের কেজি প্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।’

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে মিনিকেটের দাম ৬০ থেকে ৬৬ টাকা। বাজারে ভালো মানের নাজিরশাইলের দাম কেজিপ্রতি আরও দুই-চার টাকা বেশি।

পাইজাম চালের দাম মানভেদে ৫৩ থেকে ৬০ টাকা। আর মোটা স্বর্ণার দাম ৪৬ থেকে ৫০ টাকা কেজি।

এ বিভাগের আরো খবর