রাসায়নিক সারের সংকটের মধ্যেও পর্যাপ্ত মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং প্রয়োজনীয় কৃষি শ্রমিক পাওয়ায় টানা চতুর্থ বছরের মতো ধান উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে নেপালে।
দেশটির কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় সোমবার প্রাথমিক হিসাব তুলে ধরে এক বিবৃতিতে জানায়, এবার ৫৮ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা গত বছর থেকে ১ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
তাতে বলা হয়, এবার ফসল উপযোগী পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। লকডাউনে গ্রামে অবস্থানের কারণে কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় শ্রমিকও পাওয়া গেছে। ধানের বাম্পার ফলনের পেছনে এসব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।আরও পড়ুন: সীমিত পরিসরে চাল আমদানির সুযোগ
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও বেশি ধান উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে তাদের। যদিও রাসায়নিক সার বিতরণে সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ভুগতে হয় নেপালের কৃষকদের।
সারের সমস্যা না হলে এবার আরও বেশি ধান উৎপাদন হতো বলে মনে করেন কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব যোগেন্দ্র কুমার কারকি।
‘যদি পর্যাপ্ত রাসায়নিক সারের ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে আমরা এবার ৬০ লাখ টন ধান উৎপাদন করতে পারতাম। এরপরও উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে, সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে।’
জুনে চারা রোপণের পর উৎপাদিত এসব ধান মাড়াই করা হয়েছে নভেম্বরে।
নেপালের প্রায় পৌনে চার লাখ কোটি রুপির অর্থনীতি অনেকটাই কৃষিনির্ভর। আর বর্ষা মৌসুম দেশটির কৃষি ক্ষেত্রের আশীর্বাদ। তাদের চাষযোগ্য জমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল।
নেপালের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ধানের অবদান প্রায় ৭ শতাংশ। ধান উৎপাদনই কৃষকদের আয়ের মূল উৎস।
কৃষিমন্ত্রী কারকি জানান, নেপালে এবার ধান চাষ করা হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরে। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৮২ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ রাম কৃষ্ণ রেগমি জানান, নেপালে এবারের মৌসুমে গত তিন দশকের গড়পড়তা বৃষ্টিপাত থেকে ৩১ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। মাটিতে পুষ্টির অভাব থাকলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে তা পুষিয়ে গেছে। ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে।
ধান উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দেশ ভারত। নেপালের কর্মকর্তারা বলছেন, উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণে এবার প্রতিবেশী দেশটিতেও ধানের রেকর্ড উৎপাদন হতে পারে।
যদিও ভারতে ধানের বাম্পার ফলনের প্রভাব এখন পর্যন্ত নেপালের চালের বাজারে দেখা যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের কথা জানালেন নেপাল কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক বিজ্ঞানী ভোলা মন সিং বাসনেট।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই (ভারতে) বাড়তি উৎপাদন কৃষকদের জন্য সুখবর হবে না। এটা নেপালি কৃষকদের জন্য হতাশাজনক মূল্য বয়ে আনতে পারে। কারণ ভোক্তারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে ভারত থেকে আসা সস্তা ও মানসম্পন্ন চাল কিনতে পারে।’
নেপাল সরকার এরই মধ্যে ধানের ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এতে খুব একটা সুফল আসবে না বলে মনে করেন বাসনেট।
‘এটা নেপালি কৃষকদের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না। সরকারের চাল আমদানি তাদের হতাশ করবে। পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়ায় তা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে নেপালের খাদ্যশস্য আমদানি করা লাগতে পারে ১৩ লাখ টন। ধানের বাম্পার উৎপাদনের পরও চাল আমদানি করা লাগতে পারে ৭ লাখ ৪০ হাজার টন।
অবশ্য টানা চার বছর ধরে নেপালে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ায় দেশটির খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থান সার্বিকভাবে ভালো হিসেবে উল্লেখ করেছে এফএও।
কিছুটা উদ্বেগের কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। তাদের হিসাবে, নেপালের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ খাদ্য অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এ জনসংখ্যার বেশির ভাগই দেশটির একেবারে পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের পার্বত্য এলাকার।
এদিকে নেপাল ও ভারতে ধানের বাম্পার ফলনে স্বস্তি পেতে পারে বাংলাদেশ। এ বছর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল তিন বার বন্যায় কবলিত হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আশানুরূপ উৎপাদন হয়নি আউশ ও আমন ধান। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চালের বাজারে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর বাংলাদেশে আমদানি করা চালের বেশিরভাগ আসে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। সেসব দেশে ধানের বাম্পার ফলন স্বস্তি তো বটেই।