বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খেলাপি ঋণের বোঝা আরও বাড়বে: ইব্রাহিম খালেদ

  •    
  • ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ১১:২২

ছাড় দেয়ার কারণে যাদের ঋণ খেলাপি ঘোষণা করা যায়নি, তাদের বিষয়টি তো আর বছর বছর আটকে রাখা যাবে না। এক সময় এসব ঋণ খেলাপির খাতায় চলে আসবে। তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। এটা আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকেই ঘটতে শুরু করবে।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় বাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

রাষ্ট্রায়ত্তখাতের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বলছেন, সরকার বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করছে এবং তাদের হাতে সরকার বন্দি। ব্যাংক খাতে স্বতন্ত্র কমিশন গঠন না হওয়ার জন্য বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে দায়ী করছেন তিনি।

করোনাকালে দেশের অর্থনীতির অবস্থা, ব্যাংক খাতে আলোচিত ঋণের সুদ হার নয়-ছয় নির্ধারণ, রেমিট্যান্স, রিজার্ভসহ আর্থিক খাতের নানা বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু কাওসার ও শেখ শাফায়াত হোসেন।

করোনা পরবর্তী দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

করোনা এখনও লেগে আছে। তবে প্রথমে যেমন সব কিছু অচল হয়ে পড়েছিল, সেই পরিস্থিতির কিছুটা উত্তোরণ ঘটেছে। দোকানপাট খুলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। শিল্প-প্রতিষ্ঠানসবগুলো ভালো চলছে না। ক্ষুদ্র শিল্প আগের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা অভিযোগ করেছেন, তারা প্রণোদনার ঋণ ঠিকমতো পাচ্ছেন না। পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ইউরোপ-আমেরিকাতে করোনার প্রকোপ বেশি। ফলে সেখানকার ক্রয় আদেশ কিছুটা কমেছে। জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকে কিছু আদেশ আছে বলে পোশাকখাত এখনও চলনসই রয়েছে।

ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি হবে না- এমন নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ সুবিধা দফায় দফায় বাড়ানোর বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী ?

সময় আর বাড়ানো ঠিক হবে না। গত বছর মাত্র ২ শতাশং ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই টাকা আর ফিরে আসবে না। এটা করার পেছনে দুই-তিনজন প্রভাবশালী নেপথ্যে কাজ করেছেন। তারা এক রকম জোর করে এ ধরনের নীতিমালা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি ছিল না।

এ সংস্কৃতি অত্যন্ত খারাপ। আমাদের অর্থনীতিকে যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে, এমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল হবে।

আগামী এক-দুই বছরে ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয় হবে। কারণ, ছাড় দেয়ার কারণে যাদের ঋণ খেলাপি ঘোষণা করা যায়নি, তাদের বিষয়টি তো আর বছর বছর আটকে রাখা যাবে না। এক সময় এসব ঋণ খেলাপির খাতায় চলে আসবে। তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। এটা আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকেই ঘটতে শুরু করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়ম ঘটেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এর জন্য দায়ী কে?

ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একেবারেই অসহায়। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কিছু কিছু ব্যাংক পরিচালক এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। অন্তত দুটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রত্যক্ষভাবে বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছেন। তারা আবার অন্যদেরকে প্ররোচিত করেন।

তবে এটাও ঠিক অনেক ব্যাংকে ভালো পরিচালক আছেন। তারা পেশাদারত্বের সঙ্গে ব্যাংক চালাচ্ছেন, বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে। ফলে ব্যাংকের পরিচালকেরা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ঢালাওভাবে বলা যাবে না।

সরকারি ব্যাংকে অনিয়মের জন্য কারা দায়ী?

সরকারের দুর্বলতাই প্রধানত দায়ী। এখানেও বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ আছে। তারা সরকারকে প্ররোচিত করছে। সরকারি ব্যাংকের বড় খেলাপিদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এখানেও বড় বড় ব্যবসায়ীরা আছে। একই গাছের শেকড় চারদিকে ছড়াচ্ছে। এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে।

ব্যাংকারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন বলে কি আপনি মনে করেন ?

ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কিছু করতে পারছে। কিন্তু যখনই বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের ঋণের আবেদন নিয়ে কথা ওঠে, তখন ঋণগুলো একরকম ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কোনো হাত নেই।

ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আইন কঠোরের দরকার আছে কী ?

আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। প্রয়োগের বিষয়টি শক্তির খেলায় পরিণত হয়েছে। শক্তি আইনকে পরাভূত করেছে। সব জায়গায় হেরে গেলেও জালিয়াতরা রিট করে বসে থাকে। সেখানেও ১০ বছর ধরে মামলার নিষ্পত্তি হয় না। এক্ষেত্রে আইনের দোষ দেয়া যাবে না।

আমাদের পরামর্শ ছিল, হাইকোর্টে নির্দিষ্ট দুটি বা তিনটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেয়ার। এই বেঞ্চগুলো শুধু ব্যাংকের মামলাগুলো দেখবে। তাহলে রিট মামলা ঝুলে থাকবে না এবং প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ রক্ষা হবে না। কিন্তু এত বছর পরও তা করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক কি স্বাধীনভাবে চলতে পারছে?

একেবারেই না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন মনিব নয়, ভৃত্যের কাজ করছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে একটি ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান ও অন্য এক পরিচালক হাতাহাতির ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তখন আমরা পুরো পর্ষদই ভেঙে দিয়েছিলাম।

সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপের চেষ্টা ছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটা করতে দেয়নি।

ব্যাংকখাতের সুশাসনের জন্য পৃথক কমিশন গঠনের দাবি বহু পুরনো। এটা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

অত্যন্ত জরুরি। সরকার কমিশন করার কথা বলেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে এই সরকার দুর্বল। এ কারণে করতে চেয়েও পারেনি। ওই যে, কয়েকটা বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কথা বললাম, তাদের কারণে ব্যাংক কমিশন করতে পারছে না সরকার।

ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন হচ্ছে কি?

ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহার নয় বা ছয় শতাংশ নির্ধারণ করা নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি সুদহার নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে। সুদহার নির্ধারণ করবে বাজার। দীর্ঘদিন ধরে সুদহার বাজারের ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়ে আসছিল। এমন সময় সরকারের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়ার কোনো দরকার ছিল না।

ঋণের সুদ ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ হলে মাঝখানে স্প্রেড বা সুদহারের ব্যবধান থাকে ৩ শতাংশ। বিশ্বের অনেক দেশে তিন শতাংশ স্প্রেড আছে, কিন্তু বাংলাদেশে ৩ শতাংশ স্প্রেডে ব্যাংক চালানো সম্ভব নয়। ফলে ব্যাংকগুলো লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে। মুখে বলছে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ, নিচ্ছে হয়ত ১০ শতাংশ। আমানতের সুদ বলছে ৬ শতাংশ, নিচ্ছে হয়ত ৭ শতাংশ। এটা ব্যাংকের জন্য ভালো না, কেননা ব্যাংকগুলো চলে আস্থার ওপরে। এখানে লুকোচুরি করা ঠিক নয়।

ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমাতে সুদহার নির্ধারণ করা হয়, সরকারের এ সিদ্ধান্ত কি ঠিক হয়নি?

বড় ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে সরকার। বড় ব্যবসায়ীরা যা বলেন, সরকার তাই করছে। এটা উচিৎ না। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা হয় না। তারপরও বলব, এ সিদ্ধান্তে বড় ব্যবসায়ীরা যে খুব উপকৃত হয়েছেন তা দেখছি না।

আমানতকারীদের সুরক্ষা কে দেবে?

কেউ দেবে না। কারণ, আমানতকারীরা সংগঠিত নন। সুরক্ষা পাচ্ছেন না তারা। এ কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন। বড়দের কথায় এখন অর্থনীতি চলছে।

বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, এই অর্জনকে কীভাবে দেখছেন?

করোনা শুরুর পরপরই এক লাখ ৭০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। আসার সময় তাদের সঞ্চয়ও নিয়ে এসেছেন। প্রথম উল্লম্ফনটা ওখানেই হয়। এদের দেখাদেখি বিদেশি অবস্থানকারীরাও চাকরি হারানোর ভয়ে আগেভাগেই সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দেন।

এছাড়া সরকারের ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা রেমিট্যান্স বাড়াতে কাজ করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক এই সুবিধার সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করেছে। এসব পদক্ষেপ রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এটা ভালো। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আশা করছি।

রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কাজে ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে সরকার, এটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

ভারতের মোদি সরকার রিজার্ভ বিনিয়োগ করেছে। প্রথম দফায় মোদি সরকার যখন রিজার্ভের টাকা চেয়েছিলে তখন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর রাজি হননি। তিনি পদত্যাগ করলে অন্য একজনকে গভর্নর বানিয়ে মোদি সরকার রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে।

উদাহরণ নেই তা বলব না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে অর্থ নেয়া ঠিক হবে না। তবে সরকার যদি নিজস্ব গ্যারান্টির বিপরীতে নিতে চায়, কিছুটা নিতে পারে। অন্তত ১০ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ রিজার্ভ মজুত রেখে বাকিটা নিতে চাইলে আপত্তি থাকবে না। তবে এটাকে চর্চা বানানো যাবে না। একবারের জন্য নেয়া যেতে পারে।

করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় বাড়ছে। আইএমএফের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে মাথাপিছু গড় আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। এই অর্জনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আমাদের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। যদি বিশ্লেষণ করি কার কাছে কত টাকা, তাহলে দেখা যাবে শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট সম্পদ কুক্ষিগত। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে কিছু নেই। ভারতেও এই সম্পদ বণ্টনের গুণগত পরিস্থিতি যে খুব ভালো তা বলব না, তবে বাংলাদেশের থেকে ভালো আছে।

করোনা মহামারি না আসলে আমরা বুঝতাম না বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার কী হারে বেড়েছে। এই সময় অনেককে ভাত রান্না করে খাওয়াতে হয়েছে, এটা কিন্তু ভারতে হয়নি।

এ বিভাগের আরো খবর