করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন রাকিব আহমেদ। সাভারের এক পোশাক কারখানায় জুনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করতেন।
গত মার্চে চাকরি যায়; মাসখানেক থাকেন বেকার। লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে চাকরি পাওয়া অসম্ভব বুঝে সাত হাজার টাকা খরচ করে একটি সাইকেল কিনে ফেলেন। পাঠাওয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে ডেলিভারিম্যান হিসেবে রেজিস্ট্রেশনও করেন।
মধ্যবাড্ডায় পোস্ট অফিস গলির একটি বাসায় খাবার ডেলিভারি দিয়ে বের হওয়ার পর কথা হয় রাকিবের সঙ্গে। বলেন, ‘এখন দিনে প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মতো রোজগার করি। দিনে দুই বেলা কাজ করলে ২০-২২টির মতো ডেলিভারি দেয়া যায়।’
আগের চেয়ে মাসিক আয় বাড়ায় কাজটি করে খুশি রাকিব। ফলে পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো হওয়ার পরও অন্য চাকরির খোঁজ আপাতত আর করছেন না।
গুলশান-১ মোড়ে বাইকে বসে মোবাইলে ম্যাপে একটি ডেলিভারি লোকেশন খুঁজতে দেখা যায় নাজমুস আকাশকে। কবি নজরুল কলেজ থেকে স্নাতক পাস করার পর ডেলিভারিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
ইএমআইতে বাইক কিনে আকাশ খাবার ও পণ্য ডেলিভারির কাজ করছেন পাঁচ মাস ধরে। মাসে আয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
রামপুরা এলাকায় দেখা হয় ডেলিভারিম্যান জারাখ দ্রংয়ের সঙ্গে। তিনি রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকায় আসেন বছরখানেক আগে। ঢাকায় এসে দেখেন ‘ডেলিভারি’ একটি জনপ্রিয় ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত হয়েছে।
জারাখ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় দেখি বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছেলেরাও ডেলিভারির কাজ করছে। আমার কাছে মনে হলো, এটি করে টাকা আয় করার একটি ভালো সুযোগ আছে। এখন আমি এই কাজ করে নিজে ঢাকায় সচ্ছলভাবে থাকতে পারছি। পাশাপাশি আমার বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারি।’
কী পরিমাণ ডেলিভারিম্যান আছে, সেই সংখ্যাটা কোথাও নির্দিষ্ট করা নেই। তবে এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে, সেটা বোঝা যায় নানাভাবেই।
করোনার আগেই ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন পেজে পোশাক, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে খাবার ও আরও নিত্যপণ্য বিক্রি করা হতো। করোনাকালে পেজের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে অগুনতি।
ফেসবুকভিত্তিক পেজ মেম্বারদের ফোরাম উইমেন অ্যান্ড ই কমার্স ফোরাম-উইয়ের মেম্বার সংখ্যা এখন ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। করোনার আগে সংখ্যা ছিল এক লাখের কম।
এসব প্রতিটি পেজের অর্ডার আসে অনলাইনে। পণ্য ক্রেতাদের কাছে নিয়ে যান ডেলিভারি বয়রা।
লকডাউন পরিস্থিতিতে রেস্টুরেন্টের বদলে হোম ডেলিভারি বেশি করিয়েছেন ভোক্তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এখনও এই প্রবণতা রয়ে যায়।
রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে মহাখালী বাইকে যাত্রী নিয়ে এলেন টমাস জোয়ারদার। ভাড়া এলো ১২০ টাকা।
করোনাকালে প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকার পর আবার অ্যাপভিত্তিক বাইক সেবা আবার চালু হওয়া টমাসের জন্য স্বস্তিকর। আবার ব্যস্ত হয়েছেন তিনি। যদিও এই কয় মাস একেবারে বসে থাকেননি তিনি।
গত মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর অ্যাপে যাত্রী বহন বন্ধ হয়ে যায়। বিপদে পড়েন বাইকাররা। তবে বিকল্প বের হয়ে যায়। যাত্রীর বদলে জনপ্রিয় হয় ফুড ডেলিভারি। লকডাউন পরিস্থিতিতে মানুষ বাসায় বসে বাইরের খাবার অর্ডার করেছে বেশি। তাই টমাসদের কদর কমেনি তখনও।
টমাস জোয়ারদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাইকে যাত্রী বহন করেই আমার সংসার চলত। মার্চে রাইড শেয়ারিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি সারা দিন ২০ থেকে ২৫টি ফুড ডেলিভারি করা শুরু করি। এতে একদম আগের মতো আয় না হলেও কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছি।’
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে রাইড শেয়ারিং শুরুর পর অ্যাপে যাত্রী বহন শুরু করেছেন রাইডাররা। এর পাশাপাশি ফুড ডেলিভারিও করছেন তারা। এতে ব্যস্ততা বেড়েছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথম ফুড ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে ফুডপান্ডা। তবে এখন পাঠাও ফুড, সহজ ফুডের মতো বেশ কিছু অ্যাপ এই সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, যাদের মূল সার্ভিস ফুড ডেলিভারি ছিল না।
পাঠাও, সহজ নামগুলোর সঙ্গে মানুষের মূল পরিচয় ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ হিসেবে। মানুষের চাহিদা পাল্টে যাওয়ায় তারাও নিজেদের পাল্টাচ্ছে। যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছে তারাও।
অ্যাপগুলোর সাম্প্রতিক প্রচারণায় যাত্রী বহনের চেয়ে অ্যাপভিত্তিক সেবায় ফুড ডেলিভারিকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া শুরু করে কোম্পানিগুলো।
পাঠাওয়ের কো-ফাউন্ডার ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ ফাহাদ বলেন, ‘করোনা মহামারি আমাদের রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের ক্ষেত্রে কিছুটা স্থবিরতা তৈরি করে। তবে মানুষের ফুড ডেলিভারি সার্ভিস গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। বাইক সার্ভিসের সাথে যুক্ত থাকা প্রচুর রাইডার লকডাউনের কারণে ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে যুক্ত হয়।’
ঢাকায় পিৎজা বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ ‘চিজ রেস্টুরেন্ট’-এর এক কর্মকর্তা জানান, এখন অনলাইনেই তাদের অর্ডার বেশি আসছে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই রেস্টুরেন্টে কাস্টমারের সংখ্যা কমে গেছে। তবে ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের চাহিদা বাড়ায় প্রতি মাসেই আমাদের সাথে ডেলিভারি করার মানুষ যুক্ত হচ্ছে।’
অ্যাপভিত্তিক সেবা ‘সহজ’ জানিয়েছে, রাজধানীর দুই হাজারের বেশি রেস্টুরেন্ট তাদের মাধ্যমে খাবার পাঠাচ্ছে গ্রাহকদের কাছে।
মহাখালীর বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খাওয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। তার চেয়ে বাসায় বসে ফুড ডেলিভারি সার্ভিস গ্রহণ করাটা বেশি সুবিধাজনক। ঘরে বসেই পছন্দের খাবার পাওয়া যাচ্ছে, আবার ডিসকাউন্টও পাওয়া যায়।’
ফুড পান্ডা ও সহজ ফুডের সার্ভিস গ্রহণের জন্য ক্রেতাদের খাবারের দাম ছাড়া কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ দিতে হয় না। পাঠাও ফুডের ক্ষেত্রে খাবারের দাম ছাড়াও ৬০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয় ক্রেতাদের। তবে কিছু রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে ‘ফ্রি ডেলিভারি’ সার্ভিস চালু রয়েছে পাঠাও ফুডে।