রাজধানীর কারওয়ানবাজারের আলুর দোকান। চিত্রটা একটু অস্বাভাবিক। আলু আছে, দোকানি নেই।
কেন?
সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে, যদি কথা না শোনে, তাহলে জরিমানা হবে, এটাই ভয়।
বিক্রেতারা দোকান ছেড়ে আশেপাশে ঘুরছেন; যিনি আসছেন, তিনি ক্রেতা নাকি প্রশাসনের কেউ নাকি গণমাধ্যমকর্মী সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন তারা।
আলুর দামে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির পর গত ৭ অক্টোবর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর খুচরা, পাইকারি ও হিমাগারে দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত হয়েছে হিমাগার বিক্রি করবে ২৩ টাকায়, পাইকারিতে ২৫ টাকায় আর খুচরায় ৩০।
নির্দেশ না মানলে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের দেয়া হয়েছে নির্দেশ। আর এই চিঠিটি জানাজানি হয় বুধবার।
বৃহস্পতিবার বাজারে গিয়ে দেখা গেছে আলুর খুচরা দাম আগের দিনের মতোই ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। পাইকারিতে দাম ৩৮ থেকে ৪১ টাকা।
দাম তদারকি করা হবে এমন ভয়ে কারওয়ানবাজারে আলুর পাইকারি দোকানগুলো দেখা গেছে বিক্রেতাশূন্য।
দুটি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদককে এক ঘণ্টার বেশি ধরে হন্যে হয়ে বিক্রেতাদের খুঁজতে দেখা গেছে। কিন্তু আশেপাশে থাকা কেউ স্বীকার করছেন না, তিনিই দোকান মালিক।
পাইকারিতে কাউকে না পেয়ে খুচরা বাজারে। পাওয়া গেল নুরুল ইসলামকে। জানান, বিক্রি করছেন ৪৪ এ।
সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি সম্ভব নয় জানিয়ে নুরুল বলেন, ‘আমি কিনছি ৪১ টেকা দিয়া, কেমনে ৩০ টেকায় বেচব?’
এই বিক্রেতা জানান, গত মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মানুষ কয়েক মাস আলু কিনছে বেশি। আর এ কারণে চাপ পড়ে গেছে সরবরাহে।
সরকারের দাম বেঁধে দেয়ার খবর জেনে যারা বাজারে এসেছেন, তারা হতাশ পুরোপুরি।
শওকত হোসেন ৩০ টাকায় আলু না পেয়ে এক বিক্রেতার সঙ্গে রাগারাগি করছিলেন।
এই ক্রেতা ক্ষেপে গিয়ে বলছিলেন, ‘সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে। অথচ এত টাকা দামে বিক্রি করছে। আমি এখনই প্রশাসনকে বলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
মধ্যবয়সী লোকটি যখন উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন, তখন লোক জড়ো হয়ে যায়। ভিড় থেকে একজন বলেন, ‘ভাই খুচরা ব্যবসায়ীর কী দোষ? সে যে দামে কিনে, সে দামেই তো বেচবে। পারলে আপনি গোডাউন মালিকদের ধরতে বলেন।’
এই কথায় কিছুটা শান্ত হন শওকত। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু তদারকি তো লাগবে। নজরদারি করে দামটাকে ৩০ টাকায় নিয়ে আসতে হবে।’
খুচরা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, তিনি এক মাসে আগেও ২৫ টাকা করে কিনেছেন। তখন বিক্রি করেছেন ৩০ টাকার কমে। কাজেই সরকারের বেঁধে দেয়া দামে কিনতে পারলে ৩০ এর কমেই বেচতে পারবেন।
জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আড়ত থেইক্যা কম দামে আনলে আমরাও কম দামে বেচব। আড়তে কয়, তাগো কাছে যে আলু আছে, সেই আলু আগের বেশি দামে কেনা। এখন নতুন কইরা আলু কিনছে না।’
কারওয়ানবাজারে খুচরা বাজারে আলু বিক্রি করছেন দোকানি
খুচরা বাজারে নানা ঘটনা দেখে আবার পাইকারি আড়তে গিয়ে দেখা হলো মো. সোহেলের সঙ্গে। এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করলেন, পাইকারি ব্যবসায়ী পরিচয়ের কথা।
কেন লুকোচুরি?
সোহেল বললেন, ‘প্রশাসনের অভিযানের ভয়’ কাজ করছে তাদের।
এই ব্যবসায়ী তার আলু ক্রয়ের রশিদ দেখিয়ে বলেন, ‘আমি ৩৮ টাকায় কিইন্যা আসছি। এহন ২৫ টাকায় কেমনে বেচুম?’
‘আমার কাছে রশিদ আছে, প্রশাসন আইলে পার পাইয়া যামু, কিন্তু অনেকের কাছে রশিদ নাই, হেরা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা খাইব। হের লাইগ্যা পালাইছে।’
মোবাইল ফোনে কথা হলো শ্যামবাজারে আলু পেঁয়াজের আড়ত মেসার্স বাণিজ্য ট্রেডার্সের মালিক কাজী মোশাররফ চঞ্চলের সঙ্গে। জানান, আগের দিনের চেয়ে আড়তে দাম দুই টাকা কমেছে।
২৫ টাকায় আলু আসতে আরও সময় লাগবে উল্লেখ করে এই আড়তদার বলেন, ‘যাদের আগে বেশি দামে কেনা, তারা কিছুতেই নির্ধারিত দরে বিক্রি করতে পারবে না। তাদেরকে সময় দিতে হবে।’
মুন্সিগঞ্জের একটি হিমাগারের মালিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, আলুর মজুদ আছে পর্যাপ্ত। তবে ২৩ টাকায় তারা বিক্রি করবেন না।
সরকার খুচরা দাম ৩০ টাকা বেঁধে দিলেও সে দামে মিলছে না আলু। কারওয়ানবাজারে একটি দোকানে দাম লিখে রাখা হয়েছে।
হিমাগার মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন’ এর নেতা মোন্তাকিম আশরাফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অলরেডি হিমাগার মালিকদেরকে নির্দেশ দিয়েছি সরকারে দামে আলু বাজারে বের করে দিতে। কিছু দিনের মধ্যে সরকারের দামে আলু বাজারে পাওয়া যাবে।’
কৃষি বিপণন অধিদফতরের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে আলু সংকটের কারণ নেই। গত আলুর মৌসুমে প্রায় এক কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। তবে বছরে চাহিদা ৭৭ লাখ টনের মতো।
এই হিসাবে গত বছর চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩১ লাখ ৯১ হাজার টন। এর কিছু পরিমাণ রফতানি হলেও ঘাটতির সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।