বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এফডিসির যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অনীহা কেন নির্মাতাদের

  •    
  • ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৯:৫৪

নির্মাতা ও প্রযোজকরা মনে করেন, এফডিসিতে পোস্ট প্রোডাকশনের উন্নত যন্ত্রপাতি থাকলেও এক্সপার্ট নেই। তাছাড়া এফডিসির অপারেটররা কাজ করেন শিফট মেপে। শিফট শেষ হলেই কাজ বন্ধ।

চলচ্চিত্র নির্মাণে কারিগরি থেকে শুরু করে সবরকম সহায়তা দিতে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি)। বিপুল অর্থ ব্যয় করে সম্পাদনাসহ পোস্ট প্রোডাকশনের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। কিন্তু নতুন যুগের নির্মাতারা এফডিসির যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে কারিগরি সামর্থ্য প্রায় কিছুই ব্যবহার করেন না।

গত কয়েক বছরে দেশের আলোচিত ও ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোর কোনোটিরই পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ এফডিসিতে হয়নি।

চলতি বছরে দেশের অন্যতম আলোচিত ও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র পরাণ এর পরিচালক রায়হার রাফি মন্তব্য করেন, ‘এফডিসি একটা ভয়।’

পরাণ সিনেমার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ কোথায় হয়েছে জানতে চাইলে রাফি বলেন, ‘প্রথমে পরাণ সিনেমাটার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ ভারতে শুরু করি। কিন্তু কোভিডের কারণে সেখানে যেতে পারছিলাম না। পরে সিনেমাটির পোস্টের কাজ ঢাকায় (এফডিসির বাইরে) করা হয়েছে।’

তিনি জানান, এফডিসিতে পোস্ট প্রোডাকশনের যে যন্ত্রপাতি রয়েছে, তা বেশ ভালো বলে শুনেছেন তিনি। কিন্তু সেখানে কেউ যেতে চান না।

কারণ জানতে চাইলে রাফি বলেন, ‘মেশিনের পাশাপাশি এক্সপার্ট টেকনিক্যাল পারসনও প্রয়োজন। ভারতে কালার, গ্রাফিক্স, সিজির কাজগুলো ভালো হয়। দেশে যারা এসব কাজ ভালো করেন, তারা কেউ এফডিসিতে গিয়ে কাজ করতে চান না।’

রাফি বলেন, ‘এফসিডি একটা ভয়। তাই এফডিসির উচিৎ, যারা ভালো কাজ করেন সবাইকে ডেকে কথা বলা, এফডিসিতে কাজ করতে উৎসাহিত করা।’

দেশের আরও দুই আলোচিত চলচ্চিত্র দেবী ও হাওয়া এর নির্বাহী প্রযোজক শিমুল বিশ্বাস। তিনি জানান, এ দুই চলচ্চিত্রের পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ হয়েছে ভারতে। কারণ ভারতে যে যন্ত্রপাতি দিয়ে সম্পাদনার কাজ করা হয়, সেই প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই।

তিনি বলেন, ‘ভারতে যেগুলো আছে, তারই ছোট ভারসন বাংলাদেশে আছে। আমি দুই বছর আগে একবার এফডিসিতে গিয়েছিলাম। সেখানে কালার গ্রেডিং মেশিনটা ভালো মনে হলেও মনিটরটা ভালো লাগেনি। এরকম আরও কিছু ইস্যু রয়েছে।’

শিমুল বিশ্বাস এও জানান যে, প্রোস্ট প্রোডাকশনের কাজ সব একজায়গায় করতে পারলে তাদের জন্য ভালো। এটা ভালো তো ওটা ভালো না, এমন হলে কাজে অসুবিধা বেশি। তাছাড়া যে টেকনিশিয়ানদের দিয়ে শিমুল কাজ করাতে পছন্দ করেন, তাদের অধিকাংশেরই এখন নিজস্ব সেট-আপ রয়েছে এবং তারা এফডিসিতে যেতে চান না।

বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্রও নির্মাণ শিমুল বিশ্বাস। সেই কাজগুলোর অধিকাংশই দেশে করান তিনি। নিজেদের প্রোডাকশন হাউস বা ফ্রিল্যান্সার দিয়ে সেই কাজগুলো ভালো করা যায় বলে দাবি করেন তিনি।

অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ফিল্ম প্রোডাকশন কম্পানি ‘হাফ স্টপ ডাউন’। প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিজ্ঞাপন ও সিনেমা নির্মাণ করা হয়। এটির নির্বাহী প্রযোজক আসাদুজ্জামান সকাল নিউজবাংলাকে জানান, তিনি তার কাজ নিয়ে এফডিসিতে যান না অনেক বছর।

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেশিনের চেয়ে আমি গুরুত্ব দিতে চাই এক্সপার্টিজকে। এফডিসিতে মেশিন আছে, এক্সপার্ট নাই।’

এ ব্যাপারে কথা হয় এফডিসির চিফ অফ এডিটিং মামুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে বিভিন্ন সেকশনে স্টাফ আছেন। মূলত তারাই কাজগুলো করেন। পরিচালক যেভাবে বলবেন, তারা সেইভাবে কাজ করে দেবেন। তবে পরিচালক চাইলে তাদের পছন্দের এক্সপার্ট নিয়ে এসেও এখানে কাজ করাতে পারেন।’

এফডিসিতে কাজ করাতে কিছু ঝক্কি আছে স্বীকার করেন মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা এফডিসিতে কাজ করার শিফট রয়েছে। ৯টা-৫টা এবং ৫টা-১১টা। আমাদের এ সময়ের মধ্যে কাজ করতে হয়। কিন্তু নির্মাতারা নিজেদের সুবিধামতো কাজ করাতে চান। তাদের জন্য এ টাইম লিমিট পছন্দ নাও হতে পারে। অনেক নির্মাতা রাত জেগে কাজ করেন। অনেকে আছেন সকাল ৯টায় কাজ করতে চান না। কেউ আবার অতিরিক্ত সময় কাজ করাতে চান। আমরা তো শিফটের বাইরে কাজ করতে পারি না।’

মামুন জানান, এফডিসির মেশিনগুলো ২০১৬ সালে সেট করা। এরপর আর আপডেট করা হয়নি। তবে আরও উন্নত মানের মেশিন কেনার জন্য প্রস্তাব দেয়া রয়েছে।

এফডিসিতে এখন চারটি প্রসেসিং ইউনিট আছে, যার মাধ্যমে শুটিংয়ের ফুটেজের প্রক্সি করে এডিটিং উপযোগী করা হয় এবং করা হয় ভিস্যুয়াল এফেক্টসের কাজ। এফডিসিতে ‘ফাইনাল কাট প্রো’ নামক এডিটিং সফটঅয়্যারে ছবি সম্পাদনা করা হয়, যার মধ্যে তিনটি অফলাইন ও দুটি অনলাইন। ‘দ্য ভিঞ্চি রিসল্‌ভ অ্যাডভান্স কনট্রোল’ দিয়ে কালার করা হয় এফডিসিতে। এছাড়া ৭:১ সুবিধায় সাউন্ডের কাজ করার প্রযুক্তি রয়েছে সংস্থাটিতে।

কারিগরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না থাকা ছাড়াও আরও কিছু সমস্যা আছে এফডিসিতে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির উপ-সম্পাদক নির্মাতা কবিরুল ইসলাম রানা নিউজবাংলাকে জানান, তারা এফডিসিতে কাজ করতে চান না সময়মতো কাজ হয় না এবং অতিরিক্ত খরচ হয় বলে।

তিনি বলেন, ‘এখানে এক শিফট এডিটিংয়ের জন্য দিতে হয় ২১০০ টাকা। মানে দুই শিফট ৪২০০ টাকা। আমরা বাইরে প্যাকেজ পদ্ধতি নিলে দুই শিফটে কাজ করতে পারি ৩০০০ টাকায়।

‘আরও সমস্যা আছে। এফডিসিতে যে স্টাফ এডিটিং করেন, কাজ করার সময় তার নানা রকম খরচ, তার আশ-পাশের মানুষের খরচ, বকশিস আমাদেরই দিতে হয়। শিফট শেষ হলেই তারা কাজ বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকে। বাইরে কাজ করতে গেলে এমনটা হয় না।’

এফডিসি থেকে ক্যামেরা ভাড়া করার একটি ঘটনা উল্লেখ করে কবিরুল ইসলাম রানা বলেন, ‘ধরেন আমি পুবাইলে শুটিং করব সকাল ৯টা থেকে। তাহলে ঢাকা থেকে আমাকে ৭টার দিকে রওনা হতে হবে। কিন্তু এফডিসি থেকে ক্যামেরা নিলে সেটা ৯টার আগে বের হবে না। কারণ ৯টার সময় অফিস শুরু হবে। ক্যামেরা স্টাফ ৯টায় আসবেন, ক্যামেরা বের করবেন, তারপর স্পটে যাবেন। এভাবে তো কাজ করা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধরেন এফডিসির ক্যামেরা শিফট সিস্টেমে ভাড়া নিয়ে ঢাকার পাশেই কোথাও শুটিং করতে গেছি। রাত ১১টা বেজে গেছে, মানে শিফট শেষ, কিন্তু শুটিংয়ের আরও কিছু কাজ বাকি। ওই কাজ শেষ না করে তো আসা যাবে না। এফডিসির ক্যামেরা স্টাফ ক্যামেরা বন্ধ করে চলে আসতে চাইবে। কাজ শেষ করতে চাইলে আপনার তো ক্যামেরা রাখতে হবে। তখন ক্যামেরার ওভার টাইমের ভাড়া, ক্যামেরা স্টাফের ওভার টাইমসহ আরও নানা রকম খরচ গুণতে হয়। এগুলো আমাদের জন্য অসুবিধা।’

একই রকম সমস্যার কথা বলেছেন হাফ স্টপ ডাউনের নির্বাহী প্রযোজক আসাদুজ্জামান সকাল। তিনি বলেন, ‘একসময় তো এফডিসিতেই সবচেয়ে ভালো ক্যামেরাটা পাওয়া যেত। তখন আমরা এফডিসি থেকেই ক্যামেরা নিয়েছি। কিন্তু দেখেছি সেখানকার স্টাফদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ভালো না। ক্যামেরা সময়মতো স্পটে যায় না।’

এফডিসির বিক্রয় বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, তাদের কাজের পরিমাণ কম। তবে এর কারণ প্রোডাকশন ম্যানেজার ও পরিচালকদের কমিশনের আকাঙ্ক্ষা।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রযোজক অনেক কিছুই জানেন না বলে ভরসা করেন প্রোডাকশন ম্যানেজার ও পরিচালকের ওপর। এদের যোগাযোগ থাকে বাইরের প্রোডাকশন হাউসগুলোর সঙ্গে। ক্যামেরা, লাইট, পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ সেখানে নিয়ে গেলে কমিশন পাওয়া যায়, আর আমার এখানে আসলে তো কোনো কমিশন নাই।’

ক্যামেরা, শুটিং, পোস্ট প্রোডাকশন ছাড়াও সিনেমা সেন্সরের জন্য এফডিসির নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) একটি বড় সমস্যা হয়ে আছে চলচ্চিত্র নির্মাতের জন্য।

মস্কোর নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড, কুইন্স ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সেরা সিনেমার পুরস্কার পাওয়া আদিম সিনেমার পরিচালক যুবরাজ শামীম তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান নিউজবাংলাকে।

তিনি বলেন, ‘এনওসি নিতে এফডিসিতে গিয়ে অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে। আমি একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। এনওসি নিতে আমার প্রযোজক সমিতির সদস্য হতে হয়েছে। সমিতির সদস্য হতে লাগে ১ লাখ ৩ হাজার টাকা। এ টাকা কোথা থেকে দেব? পরে আমাকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সদস্য করা হয়েছে। আদিম সিনেমা ভালো কিছু পুরস্কার পেলেও সিনেমাটি নিয়ে এফডিসি কর্মকর্তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আমার খুবই খারাপ লেগেছে।’

এফডিসি গেলে পদে পদে বাধা, সময়মতো কাজ না হওয়া এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খরচ হয় বলে মনে করছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা।

এসব কারণে এফডিসি মুনাফা করতে পারছে না। কাজ কমে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সংস্থাটি।

এফডিসির ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেশনের নিট লোকসানের পরিমাণ ১৯ কোটি ১৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে হয় ২০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রাক্কলিত (আনুমানিক) বাজেটে লোকসানের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা হবে উল্লেখ করে প্রাক্কলন (অনুমান) করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ বিভাগের আরো খবর