‘আদিম’ সিনেমা শুরুর পর নানা লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হতে হয়েছে নির্মাতা যুবরাজ শামীম, অভিনেত্রী সোহাগী, অভিনেতা দুলালকে। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দুটি পুরস্কার জেতার পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানান তারা।
অভিনেত্রী সোহাগী বলেন, 'আমাকে অনেকেই বলেছেন, তোমাদের সিনেমা ইউটিউবে দেখাবে। টিটকারি করত আমাদের নিয়ে।'
দুলাল মিয়া বলেন, 'কত মানুষ আমাকে, শামীম ভাইকে অপমান করছে তার ঠিক নাই। প্রশাসনসহ রাজনৈতিক মানুষ এসে ঝামেলা করেছে।'
সিনেমায় অভিনয়ের বিষয়টি প্রথমে সোহাগী, দুলাল কেউই গুরুত্ব দেননি বলে জানান।
সোহাগী বলেন, 'যখন দুলাল ভাই এসে বলল যে সিনেমা করতে হবে, আমি তাকে বলেছিলাম, মশকরা করো? তার কয়েক দিন পর শামীম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে দুলাল ভাই আমাকে দেখায়ে শামীম ভাইকে বলেন, নায়িকা চলবে? শামীম ভাই বলেন, চলবে। তখনও সিনেমাটা আসলেই হবে কি না, এটা জানতাম না। তারপর আমরা তিন মাস রিহার্সেল করি। কখনও ভাবি নাই এমন কিছু হবে।'
দুলাল মিয়া বলেন, 'আমরা টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে থাকি। শামীম ভাই বস্তিতে থাকা শুরু করলে তাকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। মনে করতাম বড়লোকের ছেলে, কী থেকে কী করে। একদিন শামীম ভাই আমাকে বলল সিনেমা করবেন? এ কথা শুনে আমার আরও হাসি পায়। দুই-তিনবার বলার পর আমি রাজি হই। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলেছে মন্তব্য করেছে, এর মধ্যেও আমরা কাজ শুরু করি।
'সত্যি কথা বলতে, তিনি সিনেমা করবেন, এটা আমার বিশ্বাস হয় নাই। সে অন্য রকম একজন মানুষ।'
যুবরাজ শামীম বলেন, 'কোন ফাঁকে যেন মস্কোতে পুরস্কার পেয়ে গেল বুঝি নাই। মস্কোতে যখন যাই এয়ারপোর্টে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্তির পর যখন ফিরি, তখন এয়ারপোর্টে অনেকেই সম্মান দেখিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, 'পুরস্কার জিতে দেশে ফেরার পর যেটা ভালো লেগেছে, সেটা হলো, আমার আশপাশের মানুষ বা এলাকার মানুষ, যারা আমাকে তেমন গুরুত্ব দিত না তারা আমাকে দেখে সমীহ করছে। এ জয়কে তারা নিজেদের জয় বলে মনে করছে। মস্কোর জয়ের চেয়ে এ বিষয়টি আমার কাছে কোনো অংশে কম না।'
‘আদিম’ বাংলাদেশে কবে মুক্তি পাবে জানতে চাইলে শামীম বলেন, 'রিলিজ নিয়ে আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। আমিও জানি না সিনেমাটি কবে মুক্তি পাবে।'
শামীম আরও বলেন, 'আমি তো পরিচালক-প্রযোজক সমিতির সদস্য নই। ওখানকার সদস্য হতে যে টাকা লাগে সেটাও নেই। যদি তারা কোনো টাকা ছাড়া আমাকে সদস্য করে নেয়, তাহলে খুব ভালো হয়।'
আদিম স্বাধীন একটি চলচ্চিত্র। পরিচালক জানিয়েছেন, এর নির্মাণ খরচ ১৫ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে নেই পরিচালকসহ কলাকুশলীদের সম্মানী।
সিনেমাটির দৈর্ঘ্য ৮৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। ৫০ জনের কাছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে সিনেমাটির নির্মাণ খরচ।
সংবাদ সম্মেলনে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, 'ল্যাংড়ার ভাসমান জীবন। খুনের দায় এড়াতে সে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই যায়, সেখানেই সে নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়ায়। এমনই একদিন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনে কালা এবং কালার স্ত্রী সোহাগীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। যে পরিচয় ল্যাংড়ার জীবনে নানা রকম জটিলতার জন্ম দেয়।
'আদিম-এর মূল গল্পটা ছোট্ট করে বলতে চাইলে এমন করেই বলা যায়। কিন্তু আদিম নির্মাণের পেছনের গল্প আরও বিস্তৃত। ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রথম আদিম নির্মাণের ভাবনা মাথায় আসে এবং হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়েই আদিম নির্মাণের পরিকল্পনা করি। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডসের নির্মাতা ক্লিমেনটিনে এডারভিন আমার ভাবনা শুনে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে ২০০ ইউরো আমার হাতে ধরিয়ে দেন। যা আমাকে আদিম নির্মাণে প্রথম সাহস জোগায়। সিনেমার বাকি টাকা আমি আশপাশের মানুষের কাছ থেকে ধার নেয়ার চিন্তা করি, তখন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান আমাকে সিনেমার শেয়ার বিক্রির পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ আমার মনে ধরে।
'ক্লিমেনটিনের টাকা হাতে পেয়ে আমি টঙ্গীর ব্যাংক মাঠ বস্তিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিই, কারণ আমার মনে হয়েছে যে মানুষগুলোর গল্প আমি বলব তাদের সঙ্গে থাকাটা আমার জন্য জরুরি।
'নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আমার বস্তির দিন কাটে, মাঝেমধ্যে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ি। কিন্তু ধীরে ধীরে বস্তির কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আমার সখ্য তৈরি হয় এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই বস্তির মানুষজন নিয়েই আদিম চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করব।’
'শুটিং পর্ব শেষে আমার পোস্ট প্রোডাকশনের যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে আমার সঙ্গে শামিল হন সুজন মাহমুদ। যিনি সিনেমাটির সাউন্ড এবং কালার করেছেন। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অর্জন এবং দেশের মানুষের ভালোবাসা আদিম-এর নির্মাণের সকল যন্ত্রণা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।'