বছরের পর বছর ধরে নানা অনিময়ই যেন চলচ্চিত্র অনুদানের নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনুদান প্রদানের নীতিমালাকে অবজ্ঞা করে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক তদবির ও অন্যান্য অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহৎ এই উদ্যোগটিকে ধ্বংস করা হচ্ছে বলে মনে করছেন দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকারদের কয়েকজন।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় অসংগতির প্রতিবাদে চলচ্চিত্রকর্মী সমাবেশ করেন। চলচ্চিত্র অনুদান ২০২১-২২ এর সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিক অসংগতির প্রতিবাদে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামসহ ৩৩টি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংগঠন সম্মিলিতভাবে এ সমাবেশের আয়োজন করে।
তরুণ চলচ্চিত্রকর্মী ও নির্মাতাদের এ প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসিন মুরাদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, জাহিদুর রহিম অঞ্জন। এ ছাড়া নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, ফরিদুর রহমান, সাইয়ীদ, কাওসার চৌধুরী, এন রাশেদ চৌধুরী, হুমায়েরা বিলকিসসহ আরও অনেক সমাবেশে সংহতি জানিয়েছেন। সমাবেশে চলচ্চিত্র অনুদানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিভিন্ন প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন উপস্থিত চলচ্চিত্র নির্মাতারা।
চলচ্চিত্রকর্মী সমাবেশে সরকারের প্রতি বিভিন্ন দাবি তুলে আলোচকগণ বলেন, ‘অনুদান প্রদানের সরকারি নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে যে, অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখবে এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনমুখী, রুচিশীল ও শিল্পমানসমৃদ্ধ গল্পের চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হবে। কিন্তু বিগত তিন বছর ধরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বিভাগে কোনো প্রামাণ্যচিত্র অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়নি, যাতে স্বাভাবিকভাবেই অনুদানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
‘তেমনিভাবে বাণিজ্যিক ধারার প্রযোজক, পরিচালক যখন বেশির ভাগ সংখ্যায় অনুদানের জন্য নির্বাচিত হন তখন অনুদানের মান নিয়েই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আশঙ্কাজনকভাবে এ বছর থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্যে অনুদানের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দেয়ায় তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। এমন পরিচালকও অনুদান পাচ্ছেন যাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। যারা পূর্বে অনুদান নিয়ে নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারেননি তাদেরও পুনরায় অনুদান দেয়া হয়েছে।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রতিবাদী চলচ্চিত্রকর্মী সমাবেশ থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় গতিশীল রাখতে এবং স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রকর্মীদের সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ ও অনুদান প্রাপ্তিতে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক তদবির বা অন্যান্য অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অবসানে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করে বিবৃতি প্রদান করা হয়।
১০ দফা-
১। জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যা অনুদান নীতিমালায় বর্ণিত "মানবীয় মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনমুখী, রুচিশীল ও শিল্পমানসমৃদ্ধ' চলচ্চিত্র নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতার বিরোধী।আমাদের দাবি হচ্ছে, জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানে স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
২। অনুদান নীতিমালায় ও প্রস্তাব আহ্বানকালে প্রামাণ্যচিত্রের উল্লেখ থাকলেও গত তিন বছর ধরে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রে কোনো অনুদান দেয়া হয়নি। আমাদের দাবি এই যে, কাহিনীচিত্রের সমপরিমাণ অর্থ ও সংখ্যা সাপেক্ষে প্রতি বছর প্রামাণ্যচিত্রে অনুদান নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রামাণ্যচিত্রের জন্য পৃথক জুরি বোর্ড গঠন করতে হবে, যার সদস্যগণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা/প্রযোজক/শিক্ষক অথবা দীর্ঘসময় প্রামাণ্যচিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে।৩। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আশঙ্কাজনক হারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদানের সংখ্যা কমে গেছে। অথচ একটি মানসম্মত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রভাব কোনো অংশেই পূর্ণদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম নয়। আমরা প্রতিবছর ন্যূনতম ২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ৪০ মিনিট সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার দাবি জানাই।
৪। নির্মাতার ওপর অপ্রয়োজনীয় বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যেহেতু এফডিসির বাইরেও কারিগরি সহায়তার সুযোগ আছে, তাই এফডিসির কারিগরি সরঞ্জাম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা লোপ করতে হবে। এ ছাড়া এফডিসির এবং অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- পরিচালক সমিতি ও প্রযোজক সমিতি প্রভৃতির ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা লোপ করতে হবে।
৫। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নির্মাতাকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ জন্য-(ক) প্রথম কিস্তিতে প্রোডাকশন খরচের সম্পূর্ণ অর্থ (প্রদানকৃত অনুদানের ন্যূনতম ৬০ ভাগ) প্রদানের নিময় চালু করতে হবে।(খ) মেন্টর পদ্ধতি বিলোপ করতে হবে।(গ) চলচ্চিত্রের নির্মাণকালের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে হবে।
৬। নির্মিত চলচ্চিত্র সিনেমা হলে মুক্তির দায় প্রযোজককে না দিয়ে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনের ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
৭। অনুদান প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র্য বোর্ড/দপ্তর গঠন করে বাছাই কমিটি, অনুদান কমিটি ও প্রিভিউ কমিটিতে যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত এবং এই প্রক্রিয়াগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অনুদান সংশ্লিষ্ট মিটিং/প্রিভিউ মন্ত্রণালয়ের বাইরে উক্ত বোর্ডে কিংবা তথ্য ভবনে করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৮। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অনুদান নীতিমালার সংশোধন করতে হবে এবং মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
৯। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অনুদান প্রদানের চুক্তিপত্রে বিদ্যমান শর্তাবলি সংশোধন করতে হবে।
১০। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর বাছাইকৃত প্রস্তাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহণ রীতি চালু ও তার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে।