সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় ঢাকা এসেছেন পাঁচ দিনের সফরে। সুরজিৎকে চিনতে পারছেন তো? ‘বারান্দায় রোদ্দুর, আমি আরাম কেদারায় বসে দু পা নাচাই রে’ কিংবা ‘ফাগুনেরও মোহনায়, মনমাতানো মহুয়ায়, রঙিন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়’ গানের শিল্পী।
হ্যাঁ, তিনি কলকাতার, কিন্তু গান তাকে করে তুলেছে সবার। তার গাওয়া গান যেকোনো জায়গায়, আনন্দ নিয়ে, আনন্দ দিতে গাওয়া হয়।
এটাই শিল্পের স্বাধীনতা। নিউজবাংলার সঙ্গে আড্ডায় বলছিলেন সেটিই। রোববার সকালে যখন রাজধানীর মালিবাগে তার সঙ্গে কথা হচ্ছে, তখন তিনি বললেন, ‘আমার কাছে শিল্প মুক্ত একটা পরিবেশ, সেটার কোনো কাঁটাতার নেই, সেখানে হিন্দি, বাংলা, উর্দু নেই। এসব করতে গেলে আমরা শিল্পের গণ্ডিটা বেঁধে দিচ্ছি। আর বাঁধলে সেটা শিল্পের জন্য ভালো না।
‘কেউ যদি মনে করে যে কোনো একটা গান ওকে দিয়ে গাওয়াব, তাহলে সেখানে কেউ আর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’
এ কথা সুরজিৎ হঠাৎ করে বলছিলেন, এমন না। সুরজিতের সঙ্গে কথার শুরু শিল্পীর অভিমান প্রসঙ্গ নিয়ে।
শিল্পীর কি অভিমান থাকতে পারে না? অভিমান থাকলে কি তা তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না?
‘অবশ্যই, শিল্পীর অভিমান অবশ্যই থাকতে পারে এবং সেটা তিনি প্রকাশও করতে পারেন, কিন্তু সেটার একটা ধরন আছে। যেখানে এক ক্লিকে তোমার কথা সবাই শুনছে, সেখানে খুব কেয়ারফুল হতে হবে। তুমি একটা ইমপরটেন্ট লোক, যার কথা সবাই শোনেন, সেখানে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
‘আমরা আড্ডা, আলোচনায় অনেক কথাই বলি, কিন্তু ফেসবুক লাইভে কী বলছি সেটা নিয়ে দশবার ভাবতে হবে।’
কিন্তু কী নিয়ে অভিমান?
এই যে শিল্পীরা এত কষ্ট করে, সময় দিয়ে, শব্দ ও সুরের সঙ্গে নানা রকম যুদ্ধ করে গান তৈরি করছেন, বিশেষ করে বাংলা গান, কিন্তু সেই গান শ্রোতারা শুনতে চাইছেন না। দিনের পর দিন এমন ঘটনায় একজন শিল্পীর কি অভিমান হতে পারে না? সে ক্ষেত্রে শ্রোতারও কি কিছু দায় নেই?
সুরজিৎ কিছুটা দায় শ্রোতাদের দিতে চান। তবে তিনি শ্রোতার ইচ্ছাটাকেই প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, ‘শ্রোতার দায় কিছু তো থাকে। শ্রোতা এবং স্রোত, দেখ, বহু শ্রোতা স্রোতে গা ভাসান, তাদের অত সময় নেই। যেটা মনে হচ্ছে সেটাই শুনছেন, গানের মধ্যে বেশি কিছু খুঁজছেন না। আবার অনেক শ্রোতা আছেন, যারা গানের মধ্যে কিছু খুঁজে পেতে চান।
‘তবে এটা ঠিক খুঁজে বেড়ানো শ্রোতার সংখ্যা কমছে।’
কিন্তু কি মজার সমস্যা দেখেন। যে অঞ্চলের সংগীতশিল্পীরা তার অঞ্চলের শ্রোতাদের জন্য গান বানাচ্ছে, সেই অঞ্চলের শ্রোতারা সেই শিল্পীর গান নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। তারা উৎসাহ দেখাচ্ছেন ভিন্ন অঞ্চলের শিল্পীর গান নিয়ে। সেই অঞ্চল হোক বাংলাদেশ, হোক ভারত বা অন্য কোনো দেশ।
সুরজিৎ বলছেন, ‘এতে কোনো সমস্যা দেখি না। সমাজব্যবস্থার জন্য ক্ষতি না করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কী আর হচ্ছে? গানই তো হচ্ছে।’
তবে এর সঙ্গে সংগীতের ব্যবসায়ীদের নানা যোগ-বিয়োগের হিসাবের কথা গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথম জীবনে গান নিয়ে ঘুরছি। সব কোম্পানিই বলেছে যে গান চলবে না। সবাই বলেছে, তোমার গলা ভালো, সুরগুলো মন্দ হচ্ছে না, কিন্তু গানের কথাগুলো বদলে ফেল। এসব কথা দিয়ে হবে না। টপিকের কথা দাও।’
জীবনের গল্প থেকে কিছু কথা বলেন সুরজিৎ। তিনি বলেন, ‘একটা খবরের কাগজের (সংবাদপত্রের নাম প্রকাশ করতে চাননি সুরজিৎ) নাম দিয়ে আমাকে বলা হয়েছিল, এটা পড়ো, দেখো কোন খবর তারা পাঁচ দিন, ছয় দিন, ১০ দিন ধরে প্রকাশ করছে। সেটা নিয়ে গান লেখো।
‘‘ধরো, মাধ্যমিকে কোনো শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেটা নিয়ে গান লেখো, ‘এই কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা’। এ রকম টপিক খোঁজ।”
কিন্তু সুরজিৎ বিশ্বাস করেন ছেড়ে দিলে হয় না। একটা সংগ্রাম লাগে, যা করে এসেছেন এ শিল্পী। একসময় বাসে ওঠার পয়সা ছিল না। হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। প্রকাশ হবে কি না, রেকর্ড হবে কি না, তার কিছুই না জেনে লিখে ফেলতেন একের পর এক গান। কিন্তু এখন আর সেভাবে লেখেন না।
“এ বিষয়টা নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। একসময় কত গান লিখেছি। এখন কারণ ছাড়া লিখিই না। এখন তুমি যদি বলো, আপনি তো আরেকটা ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ লিখতে পারেননি, তাহলে আমার ভাবতে হবে যে কেন লিখতে পারিনি।
‘আমি তো লিখেই যাচ্ছি। আমার ইউটিউবে দেখবে গান তো প্রকাশ পেয়েই যাচ্ছে। একটা কোথাও জীবন অনেক সেটেল হয়ে গেছে।’
একটা থিওরিকে ভুল মনে করেন সুরজিৎ, ‘যখন গান হিট হচ্ছে বা হয়েছে, তখনকার সময়ের কথা উঠলে অনেকে বলে যে সেই সময় শ্রোতা ভালো ছিল, এখন গান হিট হচ্ছে না বলে মনে করে যে এখনকার শ্রোতা ভালো না। এটা একটা ভুল থিওরি। এটা হতে পারে যে কোথাও আমি মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারছি না।’
এবার বাংলাদেশে ঘুরতেই এসেছেন সুরজিৎ; তার বন্ধু আফজালের কাছে থাকছেন। এর মধ্যে চলছে আরেক পরিকল্পনা।
সুরজিৎ বলেন, ‘আরেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা হলো দুই বাংলার ফোক নিয়ে কিছু করা যায় কি না। প্ল্যাটফর্ম ও ইনস্টিটিউট- দুটো বিষয় নিয়েই ভাবনা আছে। তবে বিষয়টি খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে, দেখা যাক কী হয়।’
গানটাই করে যেতে চান সুরজিৎ। অনেকে তার কাছে জানতে চান, রাজনীতি করবেন কি না? উত্তরে সুরজিৎ বলেন, ‘না’।