কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে এক কাপ গরম চায়ের সঙ্গে অজস্র এলোমেলো শব্দ ভিজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কবিকে। কবি খুন হয়েছিলেন। খুনি ছিল কোনো এক জোড়া চোখ।
ক্যাফেটেরিয়া গানে এমন একটি মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছে ব্যান্ড ‘শিরোনামহীন’। ২০০৬ সালে প্রকাশ হওয়া ‘ইচ্ছে ঘুড়ি’ অ্যালবামে ছিল গানটি।
হাজার বা কোটি তরুণের মনের কথাগুলো যেন গানে গানে হাজির করেছিল ব্যান্ডটি। গানটির গীতিকার জিয়াউর রহমান জিয়া, সুর করেছিলেন জিয়া, ফারহান ও তুষার।
গানটি লেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে জিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাফেটেরিয়া যখন লিখি ও সুর করি, তখন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) পেরিয়ে গেছি, কিন্তু ছাত্রত্ব গায়ে লেগে আছে। এক ছাত্রের, এক তরুণের ক্যাফেটেরিয়ায় একটা মুহূর্তের গল্প এটি।’
জিয়ার ভাষ্যে ব্যান্ডকে সব সময় তরুণ থাকতে হয়। ১৪ বছর পর, অর্থাৎ ২০২০ সালে সেই জিয়ার কলমেই উঠে এলো ‘ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে’ গানের কথাগুলো।
তাহলে কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডটির বয়সও বাড়ছে? অন্তত গানের কথার ধরনে তো তাই মনে হয়।
স্টেজ পারফর্মেন্সে শিরোনামহীন ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
জিয়া অবশ্য বিষয়টিকে ব্যান্ডের তারুণ্য হারানোর কোনো ইঙ্গিত বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে হলো সেই মোমেন্টটা রিকল করার গল্প। প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এমনটা হয় যে তারা তাদের ফেলে আসা ক্যাম্পাসকে ফিরে দেখে। আমার নিজের ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমি যেহেতু রাইটার, আমি বহুবার বুয়েটে বারবার ফিরে গেছি, যাচ্ছি। তার পরও একটা মিস করা ব্যাপার থাকে।’
জিয়ার মতে, ‘সময় যতই যাক, সব সময় ব্যান্ডকে তরুণ মনের থাকতে হয়, এটা ব্যান্ডের স্ট্যান্ড। কিন্তু তারা যে সময়কে রি-কল করতে পারবে না, তা তো নয়।’
‘শিরোনামহীন’-এর বয়স এখন ২৫। এপ্রিলে তারা তাদের ২৫ বছর পূর্ণ করেছে। এ সময়ের মধ্যে ব্যান্ডটি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে অনেকগুলো জনপ্রিয় গান। সুর ও গানের কথার চমৎকারিত্বে শ্রোতাদের মধ্যে শিরোনামহীন-এর রয়েছে ভিন্ন একটি আবেদন।
শ্রোতাদের অনেকের মতে, শিরোনামহীন নাগরিক কবিয়াল। প্রথম অ্যালবাম থেকেই ব্যান্ডটির গানের কথা ও সুরে নগরজীবন এবং জীবন-সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে রূপক হিসেবে।
যুবক নাবিকের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনচিত্র, জনাকীর্ণ নগরদৃশ্য, ব্যস্ত ট্রাফিকের জীবন, শহুরে সংকট, শহুরে জীবনধারা ও তার কিছু বড় দৃষ্টিকোণ মূলত আধুনিক শহুরে মানুষের জীবনবোধ এবং নিত্য সংগ্রামচিত্রেরই বিবরণ।
শিরোনামহীন কি এমনই হতে চেয়েছিল? জিয়া বলেন, ‘ব্যান্ডটি এমন হতে চেয়েছিল বললে ভুল হবে, আবার হলেও মন্দ হয় না। নাগরিক কথাটিই এসেছে এ জন্য যে আমাদের গানের কথায় নাগরিক ছোঁয়া আছে। যেহেতু আমরা নগরের মানুষ, ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা নগরে। সে জন্য এটা অটোমেটিক্যালি রাইট। তা ছাড়া এই ভোকাবুলারিটা শিরোনামহীন কাব্যিকতার মাধ্যমে যেভাবে প্রকাশ করেছে, সেটা তার নিজস্বতাকে বহন করেছে।’
জিয়া আরও যোগ করেন, ‘কাব্যিকতার বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি, যেমন, গীতিকবিতা। গান কিন্তু একটা সুরের বিষয়, আমরা এখানে স্পেশাল ভোকাবুলারিটা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সেটা আমাদের এ ধরনের একটি পরিচয় যদি এনে দেয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যেরই বিষয়।’
স্টেজ শোতে শিরোনামহীনের জিয়া। ছবি: সংগৃহীত
শিরোনামহীন তার ২৫ বছরে নিজস্ব ঢঙের বাইরে যেতে চায়নি বলে জানান এ ব্যান্ডের আরেক সদস্য কাজী আহমেদ সাফিন। তিনি বলেন, ‘শিরোনামহীন সব সময় একটা জনরায় কাজ করার চেষ্টা করে। যেকোনো কাজেই আমরা চেষ্টা করি আমাদের ছাপটা যেন থাকে।’
এই ২৫ বছরে শিরোনামহীনের শ্রোতা কিছু হলেও পরিবর্তন হয়েছে বলে স্বীকার করেন সাফিন। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় গান স্টুডেন্ট লাইফেই সবাই বেশি শোনে। ব্যান্ডের প্রথম দিকে অনেককেই চিনতাম, যারা আমাদের প্রতি কনসার্টে যেত। তাদের এখন পাই না। তারা এখন আমাদের ফোন করেন, নতুন গানের ব্যাপারে কথা বলেন, কিন্তু কনসার্টে যেতে পারেন না।’
নতুন শ্রোতা আসার ফলে শিরোনামহীন সাউন্ড এবং গানের কথার ধরনে কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবছে কি না জানতে চাইলে সাফিন বলেন, ‘ব্যান্ড এসব নিয়ে ভাবছে না। ব্যান্ড যেভাবে গান করে আসছিল, সেভাবেই করার পরিকল্পনা এখনও।’
এ প্রসঙ্গে জিয়া বলেন, ‘দেখুন আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকে মাসুদ রানা পড়ি, জেমস বন্ড দেখি। ওর যে পাঠক বা দর্শক, সেটা ডে টু ডে চেঞ্জ হচ্ছে। পাঠক, দর্শক, শ্রোতা চেঞ্জ হলেও মাসুদ রানাকে তার মতোই থাকতে হবে, জেমস বন্ডকে তার মতো থাকতে হবে, তরুণদের জায়গায় নতুন তরুণ আসবে, কিন্তু শিরোনামহীনকে তার মতোই থাকতে হবে। তার বয়সটা ঠিক একইভাবে বাড়তে পারবে না। অন্তত আমাদের গানের বয়সটা বাড়তে পারবে না। গানটাকে একই স্ট্যান্ডার্ডে ধরে রাখতে হবে। সেটার জন্য আমরা খুব সচেষ্ট থাকি।’
ব্যান্ডের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভেঙে না যাওয়া, লাইনআপ ঠিক রাখা। ব্যান্ডের সদস্য পরিবর্তন শিরোনামহীন-এর ক্ষেত্রে অনেকবারই হয়েছে। তবে শ্রোতাদের চোখে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয় ২০১৭ সালে, যখন ব্যান্ডের ভোকালিস্ট তানজীর তুহিন ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান।
জিয়া বলেন, ‘যেকোনো পরিবর্তন হলে ব্যান্ডে তার প্রভাব পড়ে। সাউন্ড চেঞ্জ হয়ে যায়। তার চেয়েও বড় বিষয়, ব্যান্ড নিজেকে লো ফিল করে, অফ ফিল করে। সেই জায়গা থেকে ২০১৭ খুবই ক্রুশ্যাল ছিল।’
স্টেজ পারফর্মেন্সে শিরোনামহীন ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
ব্যান্ডে নতুন ভোকালিস্ট হিসেবে যুক্ত হন শেখ ইশতিয়াক। ২০১৭ সালের পর থেকে তার কণ্ঠেই প্রকাশ পাচ্ছে শিরোনামহীন-এর গান। তিনি কেমন করছেন? তার উত্তর শ্রোতারাই দিয়েছেন ‘জাদুকর’, ‘এই অবেলায়’, ‘কাশফুলের শহর দেখা’ গানগুলো ভালোবাসার মাধ্যমে।
শেখ ইশতিয়াক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন থেকে মিউজিক বোঝা শুরু, তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল আমি রক মিউজিক নিয়ে কাজ করব এবং ব্যান্ডে কাজ করব। এর আগে আমার অনেকগুলো ব্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স আছে। একটা সময় এসে শিরোনামহীন-এর সঙ্গে যখন কাজ করার ব্যাপারটা আসে, তখন আমার মনে হয় এখানে কাজ করা দরকার। এতে করে আমার ইচ্ছেই শুধু পূরণ হবে না, সঙ্গে অনেক কিছু শিখতে পারব।’
ইশতিয়াক মনে করেন, শিরোনামহীন তার মতো করে, একই স্ট্যান্ডার্ডে গান করছে। সেখানে তার কণ্ঠ শ্রোতারা পছন্দ করছে কি না, সেটা শ্রোতারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তার কণ্ঠে কিছু গান শ্রোতারা পছন্দ করেছেন বলে মনে হচ্ছে তার।
তিনি বলেন, ‘ব্যান্ড সদস্য যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে এবং এটি একটি নিয়মিত ঘটনা ব্যান্ডের ক্ষেত্রে। যেটাই হোক, শিরোনামহীন তার ঢঙেই থাকবে। যখন আমরা যে লাইনআপে থাকি, তখন সেটাকেই সবচেয়ে ভালো লাইনআপ মনে হয়।’
ব্যান্ডে নতুন কাউকে যুক্ত করা বা নতুন কাউকে প্রস্তুত করার কোনো প্রক্রিয়া শিরোনামহীনের আপাতত নেই বলেও জানান সাফিন।
২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের অনেক জায়গায় কনসার্টে অংশ নিয়েছে শিরোনামহীন। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে ২৬ মে। সেদিন ব্যান্ডটি মঞ্চে উঠবে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে। ভারতের মুম্বাইয়ের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বাজাবে ব্যান্ডটি। দেশের নামকরা, খ্যাতিমান মিউজিয়ানরাও সেদিন শিরোনামহীনকে সম্মান জানিয়ে বাজাবে শিরোনামহীন-এর হয়ে।
শিরোনামহীনের ভোকাল শেখ ইসতিয়াক। ছবি: সংগৃহীত
জিয়া জানান, দেশে এমন ঘটনা নতুন হলেও গ্লোবাল মিউজিকে এ রকম আয়োজনের উদাহরণ রয়েছে। মেটালিকা এবং স্করপিয়নস-এর বিখ্যাত লাইভ অ্যালবাম ‘এস অ্যান্ড এম’ কিংবা বার্লিন ফিলহারমোনিকের সঙ্গে অর্কেস্ট্রার আয়োজন দেখা গেছে।
জিয়া বলেন, ‘এ নিয়ে আমাদের অনেক প্রস্তুতি। আমাদের আলাদা আলাদা ট্র্যাক বানাতে হয়েছে। আমাদের প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে, কারণ আমরা একটা নোটও ভুল করতে চাই না। এ রকম আয়োজন করতে অনেক পরিশ্রম ও খরচ। এ ধরনের আয়োজন ব্যান্ডের লাইমটাইমে একবারই হয়।’
নতুন অ্যালবামও আসবে শিরোনামহীনের। অ্যালবামের নাম ‘পারফিউম’। এতে থাকবে আটটি গান, যার বেশ কিছু গান এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক ‘পারফিউম’ প্রকাশ হবে ২৬ মে।
শিরোনামহীন-এর বর্তমান লাইনআপ: জিয়াউর রহমান জিয়া (গীতিকার, সুরকার, বেস, চেলো, সরোদ), কাজী আহমাদ শাফিন (ড্রাম, সরোদ, বাঁশি), দিয়াত খান (লিড গিটার), শেখ ইশতিয়াক (ভোকাল), সাইমন চৌধুরী (কিবোর্ড)।