ওভার দ্য টপ বা ওটিটি নীতিমালাকে শিল্প, শিল্পী ও সৃজনশীলতা নিয়ন্ত্রণের ফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন সমালোচক ও নির্মাতা।
নীতিমালার ভূমিকায় ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের সুবিধার্থে ওটিটি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করতে সরকার বদ্ধপরিকর’ বলে উল্লেখ থাকলেও সমালোচকদের মতে এ নীতিমালার কারণে খণ্ডিত হবে শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা।
২৬ ফেব্রুয়ারি নীতিমালা নিয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদ। সেখানেই এমন মন্তব্য করেন আলোচকরা।
‘ওটিটি নীতিমালা: নির্মাণের স্বাধীনতা নাকি দমন ও নিয়ন্ত্রণের ফাঁদ’ শিরোনামের এ ওয়েবিনারে অংশ নেন লেখক ও অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, চলচ্চিত্র গবেষক, লেখক ও অধ্যাপক আ আল মামুন, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক বেলায়াত হোসেন মামুন এবং ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগর।
নীতিমালার বিভিন্ন ধারা ও নিয়ম নিয়ে বিশ্লেষণ করেন আলোচকরা। বেলায়াত হোসেন মামুন নীতিমালাটিকে ব্যবসাবান্ধব বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তিনি নীতিমালার ১৩ নম্বর ধারাটি নিয়ে বিষদ আলোচনা করেন।
বেলায়াত বলেন, “১৩ ধারার ৩ উপধারায় বলা হচ্ছে – ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ বা কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টি করতে পারে- এই ধরনের কোনো উপকরণ তৈরি বা সম্প্রচার করা যাইবে না।’ এটি একটি গড় কথা আমাদের উপমহাদেশে আইন-কানুনের মধ্যে। আমি নিশ্চিত, যারা ওটিটির খসড়া প্রণয়ন করেছেন, তারা আমার কথা শুনলে মনে করবেন যে আমি তাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছি।
‘১৩ ধারার ৪ উপধারায় সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে এমন কনটেন্ট নির্মাণ না করার কথা বলা আছে। কোনো নির্মাতা যদি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কোনো সাম্প্রদায়িক বা জঙ্গি হামলার ওপর সিনেমা নির্মাণ করতে চান বা বস্তুনিষ্ঠতার কাছাকাছি যেতে চান বা যা ঘটেছে তা-ই পর্দায় হাজির করতে চান, তাহলে নীতিমালার এ ধারার কারণে তিনি আর তা পারবেন না। এ বিষয়ে সিনেমাই নির্মাণ করা যাবে না।’
অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর এমন কনটেন্ট সম্প্রচার/প্রদর্শন যাবে না বলে উল্লেখ আছে ১৩ ধারার ৭ উপধারায়।
বিষয়টি নিয়ে বেলায়াতের বক্তব্য: ‘আমরা সব দেশকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই। ভালো কথা। কিন্তু বন্ধুকে ক্রিটিক্যালি দেখতে পারব না, সে কেমন কথা। ফেলানিকে নিয়ে একটা সিনেমা বানাতে চাই, বর্ডার কিলিং নিয়ে সিনেমা বানাতে চাই– পারব না, সৌদি আরবে আমাদের নারী শ্রমিকরা যেভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তা নিয়ে কাজ করতে পারব না, প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন দেশে যেভাবে শোষণ ও নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন, তা নিয়ে কাজ করতে পারব না।’
লেখক ও অধ্যাপক ফাহমিদুল হক নীতিমালা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতা তুলে ধরেন।
তিনি ওটিটিকে মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচইয়ের জন্য এক রকম বাস্তবতা, আর চরকির জন্য যদি আলাদা বাস্তবতা হয়, তাহলে কেমন হবে? আমি তো যা একটু ডায়নামিক, এক্সাইটিং, ‘অশ্লীল’, সেগুলোতেই আগ্রহী হব। যেখানে গ্ল্যামার নেই, দাঁত নেই, নখ নেই, সেই কনটেন্ট আমরা কেন দেখতে যাব।”
ফাহমিদুল হকের মতে, নীতিমালার ভেতরের ধারাগুলো পড়লেই বোঝা যায় সেখানে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা আছে।
তিনি বলেন, ‘এ সরকারের আমলে অনেক নীতিমালা হয়েছে। যেমন: ২০১২ সালে অনলাইন নীতিমালা, ২০১৪ সালে সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এরপর চলচ্চিত্র নীতিমালা, সেন্সর সার্টিফিকেশন– সবখানেই নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা আছে। ভেতরের ধারাগুলো পড়লেই বোঝা যায়।’
লেখক ও অধ্যাপক আ আল মামুন ওটিটি নীতিমালার পাশাপাশি বিটিআরসির একটি নীতিমালার কথাও উল্লেখ করেন তার আলোচনায়।
‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস ২০২১’ নীতিমালার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধরেন অন্য সব নিয়ম-কানুন পাশ কাটিয়ে আপনি যদি কোনো কিছু প্রদর্শন করতে চান, আপনার কোনো বক্তব্য কোথাও প্রকাশ করতে চান বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতে চান, তার জন্য নিয়ম আসছে। তার মানে আপনার কোনো রকম এক্সপ্রেশনের স্পেস রাখা হবে না।’
তবে মামুন উল্টো পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আইনগুলো হওয়া দরকার বলে মনে করেন। কীভাবে সময়ের সঙ্গে নিজেদের মেলানো যাবে, সেখানে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি।
নীতিমালায় অনেক বিষয়েই অস্পষ্টতা আছে উল্লেখ করে মামুন বলেন, ‘আমি যখন পড়ছিলাম ওটিটি নীতিমালাটা, তখন দেখছিলাম, অনেক কিছু বলা নাই, কিন্তু সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রচলিত আইনের মধ্যে। ভূমিকায় বাক ও বিবেকের স্বাধীনতা বলার পর নীতিমালায় যা আছে, তা মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণের মেকানিজম নির্দেশ করে।’
ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগর ২.১, ২.২ এ যে ‘অশ্লীল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট বলে মনে করেন। তার মতে, ‘অশ্লীলতার কোনো ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা নীতিমালায় নাই। তাই আনডিফাইন্ড শব্দ ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা কী।’
ওটিটি নীতিমালাটি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় এবং মতামত দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। ৭ মার্চ সে সুযোগটির সময় শেষ হয়েছে।